অবশেষে সূচিত হলো নতুন দিগন্তের। খুলে গেল নতুন দ্বার, যেখানে উজ্জ্বল সম্ভাবনার আলোকছটা আলো ছড়াতে শুরু করেছে । এই আলোয় আলোকিত হয়ে উঠবে একদিন পার্বত্য চট্টগ্রামের জনপদ। উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত আগামী দিনের ভবিষ্যৎ কর্ণধারাদের একদিন আমরা গৌরবের সাথে বলতে পারবো তোমাদের এই উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির যাত্রাকালে আমরাও ছিলাম। ছিল অনেক প্রতিকূলতা, ছিল অনেক বাধা, কিন্ত কোনও কিছুতেই আমরা নিজেদের দমিয়ে রাখিনি। আমরা আমাদের অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছিলাম।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি রাঙামাটি সফলকালে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেছিলেন রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যালয় এবং রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের। সেই শুভ সূচনার পর অনেক বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও ২০১৫ সালে এসে এই দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এর শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। এখানেও ছিল অনেক বাধা এবং শংকা । তবে সব কিছু পাড়ি দিয়ে আজ এই দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পার করছে চলার ৩ বছর। ধীরে ধীরে সকল প্রতিকূলকতাকে পাশ কাটিয়ে এখন স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে এই দুটি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
২০১৫ সালের ৯ নভেম্বর রাঙামাটি শহরের শাহ উচ্চ বিদ্যালয়ের কয়েকটি কক্ষ নিয়ে দুটি বিভাগের ১০০ শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে রাঙামাাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়। স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ ড. প্রদানেন্দু বিকাশ চাকমা উপাচার্য হিসাবে কঠিন দায়িত্ব নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন এই বিশ^বিদ্যালয়ের। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের ভেদভেদীস্থ আবাসিক ভবনের কয়েকটি কক্ষে শুরু করা হয় বিশ^বিদ্যালয়ের দাপ্তরিক কর্মকান্ড। অস্থায়ী ক্যাম্পাস এবং অস্থায়ী বিশ^বিদ্যালয় কার্যালয় এই দুটি অস্থায়ী পরিচয় হয়তো বা আরো কিছুদিন বয়ে বেড়াতে হবে বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে। তবে তা যে সুদুঢ় সময় নয়, সেটি এখন নিশ্চিত।
শুরুতে যে নতুন দিগন্তের কথা বলছিলাম সে দিগন্তটি সূচিত হয় ৪ নভেম্বর শনিবার সকালে। রাঙামাটি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে এদিন রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় আনুষ্ঠানিকভাবে আইনসম্মতভাবে মালিকানা পেয়েছে ৬৪ একর জমির। রাঙামাটির রাঙাপানি এলাকার মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশের এই ৬৪ একর জমিতে স্থায়ী ক্যাম্পাস স্থাপন করা হবে রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের। বাংলাদেশ বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আব্দুল মান্নানের উপস্থিতিতে রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসি ড. প্রদানেন্দু বিকাশ চাকমার হাতে ৬৪ একর জমির মালিকানার কাগজ হস্তান্তর করেন রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মানজারুল মান্নান। রাঙামাটির বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. মানিক লাল দেওয়ানসহ রাঙামাটির বিশিষ্টজনসহ সরকারি দপ্তরের সিনিয়র কর্মকর্তাগণ এই সময় উপস্থিত ছিলেন।
একই দিন সন্ধ্যায় রাঙামাটি পর্যটন কর্পোরেশন মোটেলে অনুষ্ঠিত স্বল্প পরিসরের মত বিনিময় সভায় বাংলাদেশ বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আব্দুল মান্নান শনিবারের সকালের জমির মালিকানা হস্তান্তরের শুভক্ষণটিকে রাঙামাটিবাসীর জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন হিসাবে উল্লেখ করে বলেন, রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের জন্য আরো অনেক ভাল দিন কিংবা সুখবর আসবে, তবে আজকের এই দিনটি এই বিশ^বিদ্যালয়ের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
উভয় অনুষ্ঠানে মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান তাঁর বক্তব্যে বলেন, বিশ^বিদ্যালয়ের এই জায়গায় নান্দনিক নির্মাণশৈলীর মাধ্যমে প্রকৃতির সৌন্দর্য যথাসম্ভব অটুট রেখে নির্মাণ করা হবে এই বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাস। আর এই ক্যাম্পাস নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের বিষয়ে সরকারের আন্তরিকতার বিষযটি উল্লেখ করেন। বিশ^বিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ না হওয়া পর্যন্ত অস্থায়ী ক্যাম্পাসে নানান প্রতিকূলতার মধ্যেও বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠূভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে তিনি বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন এবং শিক্ষার্থীদের সহায়তা কামনা করেন।
ফিরে আসা যাক রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় স্থাপনের প্রথম দিককার কিছু প্রতিকূল পরিবেশের কথায় । শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার ৯৬ সালে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে আসার পর রাঙামাটিতে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ^বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়। বিশিষ্ট অর্থনিিতবিদ চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক সেকান্দার হায়াত স্যারকে এই বিশ^বিদ্যালয় স্থাপনের প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব দেয়া হয়। বিশ^বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ও বরাদ্দ দেয়া হয়। তবে এই বিশ^বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগের শুরু থেকেই স্থানীয়ভাবে এর বিরোধিতা করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় একাধিক প্রভাবশালী রাজনৈতিক সংগঠন এর বিরোধিতায় সরব হয়ে উঠেন। পরবর্তীতে ক্ষমতার রদবদলে বিএনপি-জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় আসলে এই বিশ^বিদ্যালয় স্থাপনের বিষয়টি আর বেশি অগ্রসর হয়নি। জানা যায়, পরবর্তীতে এই বিশ^বিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ অন্যত্র বরাদ্দ দেয়া হয়।
২০০৮ সাল পর্যন্ত রাঙামাটিতে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের এই প্রক্রিয়াটি বন্ধ থাকলেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে আবারো দেশ পরিচালনার দায়িত্বে আসার পর শুরু থেকেই রাঙামাটিতেও আবারো একটি পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় স্থাপনের বিষয়টি আলোচনায় আসে। এবার যোগ হয় বিশ^বিদ্যালয়ের সাথে সাথে রাঙামাটিতে একটি মেডিকেল কলেজ স্থাপনের ঘোষণা। এই দুটি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের উদ্যোগের বিরোধিতায় আবারো সরব হয়ে উঠে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অঙ্গন। এবারের বিরোধিতা কঠোর হওয়ায় বিশ^বিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের পক্ষের লোকজনের মধ্যে আবারো হতাশা সৃষ্টি হয়। তবে হতাশার মাঝেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিম্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপনের পক্ষে কঠোর অবস্থানে সবাই আশায় বুক বাঁধে। এবার বিশ^বিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপনের পক্ষে মাঠে নামে পক্ষের অনুসারীরা। ক্ষমতাসীন দলের সদস্য হিসাবে তৎকালীন পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার ও তাঁর অনুসারীরা এবং আওয়ামী লীগের সিংহভাগ নেতা-কর্মীরা এবার সরব ছিলেন । রাঙামাটির প্রবীণ সাংবাদিক ও সংগঠক সুনীল কান্তি দেসহ বিভিন্ন পেশাজীবি মহলের প্রতিনিধিরাও এ বিষয়ে মাঠে নামেন। তবে সব কিছুর পরেও অনিশ্চয়তা ছিল এই দুটি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্থাপনায়। তবে ২০১৩ সালে রাঙামাটিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাঙামাটি সফরকালে এই দুটি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের পর সকল অনিশ্চিয়তা কেটে যায়। তবে পরবর্তীতে এই দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম বিলম্বিত হওয়ায় আবারো অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়। তবে এবার এই দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষের লোকজনের সংখ্যা বাড়তে থাকে। জাতীয় রাজনীতিতে বিরোধিতা থাকলেও এখানে বিএনপির পক্ষের লোকজনও বিশ^বিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের পক্ষে অবস্থান নেয়।
তবে আশা নিরাশার দোলায় দুলতে থাকা রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যায় এবং মেডিকেল কলেজ এর পক্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় অবস্থানে সকল অনিশ্চয়তাকে দূর করেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের জন্য জায়গা পেয়েছে। রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের জন্য জায়গা পাওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই রাঙামাটিতে জ্বলজ্বল করবে রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজের স্থায়ী ক্যাম্পাসের সাইন বোর্ড। সারি সারি একাডেমিক ভবন আর শ্রেণি কক্ষ মূখরিত থাকবে শিক্ষক আর শিক্ষার্থীর পদচারণায়। এসব শিক্ষার্থীদের সিংহভাগই হবে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের। সেদিন অন্তত এই বলে নিজেকে ধন্য মনে করবো আর তা হচ্ছে আমাদের একদিনের স্বপ্ন ছিল আর তা আজ বাস্তবে রুপ নিয়েছে। স্বপ্ন বাস্তবায়নের এই যাত্রায় আমি এবং আমরাও ছিলাম।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও অধ্যক্ষ, রাঙামাটি শিশু নিকেতন।
১ Comment
Wow