কারো বিরুদ্ধে আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের হামলা, মামলা নির্যাতনসহ পাহাড়সম অভিযোগ। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ দলটির রাজনীতি প্রশ্নবিদ্ধ করার। কেউবা যোগ্যতার চেয়ে পেয়েছেন বড় পদ। রয়েছে পারিবারিক প্রভাব। আবার রাজনীতি থেকে দূরে থাকা ব্যক্তিরও ঠাঁই হয়েছে খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামীলীগের প্রস্তাবিত কমিটিতে।
এই নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করেছে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। এতে ত্যাগী, নির্যাতিত নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। বিতর্কিত ব্যক্তি দিয়ে গঠিত এমন কমিটির কারণে ভবিষ্যতে দলটির সাংগঠনিক কার্যক্রম দুর্বল হয়ে যাবে বলে মনে করছেন তাঁরা।
দীর্ঘ সাত বছর পর গত বছরের ২৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিত সম্মেলন অনুষ্টিত হয়। সম্মেলনে খাগড়াছড়ির সংসদ সদস্য দ্বিতীয় বারের মতো সভাপতি নির্বাচিত হন। আলোচনার ভিত্তিতে নির্মলেন্দু চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক এবং মো: দিদারুল আলমকে প্রথম সাংগঠনিক সম্পাদক ঘোষণা করা হয়।
সম্মেলনের তিন মাসের মাথায় ২০জন উপদেষ্টা ও ৭৫সদস্য বিশিষ্ট প্রস্তাবিত খাগড়াছড়ি জেলা কমিটি কেন্দ্রে পাঠিয়েছে সভাপতি-সম্পাদক। তারা বলছেন বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে এমন কমিটি গঠন করা হয়েছে। যদিও কেন্দ্র থেকে বারবার বিতর্কিত ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে দল সাজানোর কথা বলা হচ্ছে। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদকের কাছে কমিটি জমা দেয়া হয়।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, পুরাতন কমিটি ৭১ সদস্য বিশিষ্ট হলেও প্রস্তাবিত কমিটি করা হয়েছে ৭৫ সদস্য বিশিষ্ট। এরমধ্যে সহ সভাপতি ও সদস্য পদ দুটি করে বাড়ানো হয়েছে। কমিটি থেকে বাদ পড়েছেন পুরাতন কমিটির ২১জন। যুক্ত হয়েছেন ২২জন নতুন সদস্য। পুরাতন কমিটির ৩সদস্য পেয়েছেন পদোন্নতি। কমিটির ২০টি পদ অপরিবর্তন থাকলেও ১৫টি পদে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।
জেলা আওয়ামীলীগ থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বেশি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন খাগড়াছড়ির আলোচিত-সমালোচিত পৌর মেয়র মোঃ রফিকুল আলমের ক্ষেত্রে। তিনি প্রস্তাবিত কমিটির সদস্য। মেয়র রফিক গত পৌর নির্বাচনের পর থেকে আওয়ামীলীগের সাথে সংঘর্ষ, মামলা, হামলা, নির্যাতনের কয়েক ডজন ঘটনায় অভিযুক্ত। এমনকি মেয়রের অনুসারীদের হাতে দলটির সাধারণ সম্পাদক মারধর ও লাঞ্চিত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। স্থানীয় আওয়ামীলীগের রাজনীতি চ্যালেঞ্জার মুখে ফেলে দিয়ে জেলায় ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টির জন্য তাকে দায়ী করা হয়। ক্ষত শুকানোর আগেই দলে তাকে পদ দেয়ায় ক্ষুব্ধ তৃণমুল।
এদিকে পৌর নির্বাচনে শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত জেলা আওয়ামীলীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক জাহেদুল আলম হয়েছেন প্রস্তাবিত উপদেষ্টা কমিটির সদস্য। রফিকুল আলম জাহেদুল আলম ও দিদারুল আলমের ভাই।
প্রস্তাবিত কমিটির প্রথম সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা রণ বিক্রম ত্রিপুরা বলেন, ‘যে ব্যক্তি দলের নেতাকর্মীদের নির্যাতন করেছে, পঙ্গু করেছে, মামলা দিয়েছে। রাসেলকে হত্যা করেছে। যে ব্যক্তি সভা-সমাবেশে ‘আম্বালীগ’, ‘মহাজট’ বলে কটাক্ষ করেছে, বঙ্গবন্ধুকে হেয় করে কথা বলেছে। আমিসহ সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করেছে সে কিভাবে দলের সদস্য পদ পায় তা আমার বোধগম্য নয়। প্রস্তাবিত কমিটি গঠন নিয়ে তার সাথে কোন আলোচনা হয়নি বলেও জানান তিনি।
প্রস্তাবিত কমিটির সহ সভাপতি মনির হোসেন খান বলেন, নেত্রী বলছে খারাপ ও বিতর্কিত লোকদের বাদ দিয়ে দল সাজাতে। সেখানে এমন লোক দলে কিভাবে ঠাঁই হয়। রফিকের হাতে দলের ধর্মীয় গুরু, সাংবাদিক, স্থানীয় বাসিন্দারা নির্যাতন মামলা, হামলার শিকার হয়েছে। বহু নেতাকর্মী নির্যাতন, মামলা, হামলা, পঙ্গু হওয়ার পর এখন যদি সে দলের সদস্য পদ পায় এরচেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে না। নেতাকর্মীরা এটি কোনভাবে মেনে নিতে পারবে না। দলে এটির ভয়াবহ প্রভাব পড়বে। গৃহদাহ শুরু হবে।
এই বিষয়ে খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্মলেন্দু চৌধুরী জানান, আমরা বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভেবে কমিটি সাজিয়েছি। এতে সব শ্রেণির প্রতিনিধি রাখা হয়েছে।
খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও স্থানীয় সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার ছেলে ত্রিশোর্ধ ভারতেশ্বর ত্রিপুরাকে প্রস্তাবিত কমিটির সদস্য করা হলেও এতে ঠাঁই হয়নি সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য বাসন্তী চাকমার। বয়স অনুপাতে প্রস্তাবিত কমিটিতে সে কনিষ্ঠতম সদস্য। কমিটিতে একমাত্র নারী হিসেবে শতরূপা চাকমা মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা পদে অপরিবর্তিত রয়েছেন।
রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত না থাকার পরও মূলত সভাপতি(কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুুরা)বাবার কারণে ভারতেশ্বর পদ পাওয়ার অভিযোগ করেছেন নেতাকর্মীরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নেতাকর্মী অভিযোগ করে বলেন, যদি ভারতেশ^রকে রাজনীতিতে আনার ইচ্ছে থাকে তাহলে সহযোগী সংগঠনে পদ দেয়া যেত। হুট করে জেলা আওয়ামীলীগের সদস্য পদ দেয়া ঠিক হয়নি। এতে দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির সাথে থেকেও পদ না পাওয়া নেতাকর্মীরা হতাশ হবে। দীর্ঘ রাজনীতি করার পর এমন পদ নেতাকর্মীদের কাছে সাধনার, সম্মানের। কিন্তু বিতর্কিত ব্যক্তিদের আনায় বর্তমান কমিটি প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
প্রস্তাাবিত কমিটিতে ‘হুট করে বড় পদ’ পেয়েছেন জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক আহ্বায়ক পার্থ ত্রিপুরা জুয়েল ও খাগড়াছড়ি কাঠ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শওকত উল ইসলাম। জেলা আওয়ামীলীগে অভিষেকেই পার্থ ত্রিপুরা পেয়েছেন সাংগঠনিক সম্পাদক পদ এবং শওকত উল ইসলাম পেয়েছেন বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক পদ। পার্থ ত্রিপুরা রণ বিক্রম ত্রিপুরার ছেলে। মূলত প্রভাবশালী মন্ত্রীকে দিয়ে শওকত উল ইসলাম জেলা কমিটির পদ ভাগিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
কমিটিতে তিন সিনিয়র আওয়ামীলীগ নেতার ছেলে সদস্য হয়েছেন। তারা হলেন আওয়ামীলীগের সাবেক উপদেষ্টা মরহুম মুক্তিযোদ্ধা দোস্ত মোহাম্মদ চৌধুরীর ছেলে আফতাফ উদ্দিন চৌধুরী, সাবেক সংসদ সদস্য প্রস্তাবিত কমিটির প্রধান উপদেষ্টা যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরার ছেলে অপূর্ব ত্রিপুরা ও সাবেক উপদেষ্টা নূরন্নবী চৌধুরীর ছেলে শামিম চৌধুরী। এদিকে নূরন্নবী চৌধুরীকে জাতীয় পরিষদের সদস্য করার বিষয়ে কেন্দ্রে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। তিন আওয়ামী পরিবারের সন্তানকে সদস্য করার বিষয়টিকে সাধুবাদ জানিয়েছে নেতাকর্মীরা।
পুনর্গঠিত প্রস্তাবিত কমিটিতে দুটি সহ সভাপতি পদ বেড়ে হয়েছে ১১টি। তাতে ৮জন অপরিবর্তিত থাকলেও নতুন পদ পেয়েছেন মংক্যচিং চৌধুরী, তপন কান্তি দে ও মোঃ শামছুল হক। পদোন্নতি পেয়ে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদ পেয়েছেন নতুন তিন মুখ। তাঁরা হলেন পুরাতন কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল জব্বার ও এডভোকেট আশুতোষ চাকমা, যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক মংসুইপ্রু চৌধুরী অপু।
প্রস্তাবিত কমিটিতে পদোন্নতি পাওয়াদের মধ্যে রয়েছেন তৃতীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিকুর রহমান ফারুক, জেলা কমিটির যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক জুয়েল চাকমা, শিক্ষা ও মানব সম্পদ সম্পাদক পদে অধ্যাপক নীলোৎপল খীসা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক খোকনেশ্বর ত্রিপুরা, দপ্তর সম্পাদক পদে চন্দন দে এবং উপ-দপ্তর সম্পাদক পদে নুরুল আজম অন্যতম।
কমিটির প্রথম সদস্য করা হয়েছে সাবেক সংসদ সদস্য একেএম আলিম উল্লাহ। অন্য গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরা হলেন সতীশ চাকমা, হাজী মো: কাশেম, মোঃ শানে আলম, জেলা যুবলীগ সভাপতি যতন কুমার ত্রিপুরা, পানছড়ির বাহার মিয়া ও জয়নাথ দেব, সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রইস উদ্দিন, রণ বিক্রমের জামাতা অনন্ত ত্রিপুুরা, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এড. নুরুল্লাহ হিরো, বরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা অন্যতম।
অপরিবর্তিত থাকাদের মধ্যে আইন বিষয়ক সম্পাদক এডভোকেট রতন কুমার দে, শ্রম সম্পাদক কামাল উদ্দিন পাটোয়ারী, শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক এস. অনন্ত ত্রিপুরা, কোষাধ্যক্ষ গোলাম মোহাম্মদ চৌধুরী’র নামটি নিশ্চিত হওয়া গেছে।