স্বল্প আয় আর সাদামাটা জীবনে কিছুটা ছন্দ আনতে সপ্তাহে প্রায় প্রতিদিন বনরূপা বাজারে আসেন শান্তি চাকমা, সুরুজ মনি চাকমা আর সাধনা চাকমা। বিভিন্ন কাঁচা সবজি থুরুংয়ে করে আনেন বাজারে বেঁচতে, এদের মধ্যে শান্তি চাকমা আর সাধনা চাকমা আসেন প্রায় কাউখালীর কাছাকাছি দুদুমাছড়া থেকে আর তার পাশের গ্রামের সুরুজ মনি চাকমা। প্রায় সমবয়সি প্রত্যেকই দু সন্তানের জনক ও জননী।
সুরুজ চাকমা জানালেন তার যে ফসলি জমি আছে তাতে উৎপাদিত ফসলে সাড়া বছর চলেনা, তাই আয় বাড়াতে কাঁচা মালের ব্যবসা করেন, তার আয় বেশ ভালোই। সারদিন বেঁচাকেনা করে প্রায় হাজার টাকা মুনাফা হয়, সেটা দিয়ে বেশ ভালো ভাবেই তার সংসার চলে, দু’পুত্র সন্তানের জনক সুরুজ চাকমা স্বপ্ন দেখেন সন্তানরা ভালোভাবে পড়ালেখা করে চাকরি করবে, সেদিনই তার বাজার জীবনের অবসান হবে। তার শেষ কথাটা এমনই ছিল- ‘ মানুষ বাঁচে স্বপ্ন নিয়ে, আমিও তার ব্যাতিক্রম না।’
সাধনা চাকমা দুদুমাছড়ার নিজ জমিতে উৎপাদিত পণ্য বাজারে বেঁচেন, আয় মোটামুটি, এক ছেলে এক মেয়ে, ছেলে এবার ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয় হতে এস এস সি পরিক্ষা দিবে, মেয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে উঠবে,তাদের একটু ভালো ভাবে চালাতেই এতো কষ্ট করেন, তিনি চান না, তার মত জুম চাষ করে তার প্রজন্ম টিকে থাকুক। ওদের যোগ্য মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে চান। যাতে তার প্রজন্ম নিশ্চিন্ত জীবন পায়, যতদিন শক্তি সামর্থ্য আছে, ততদিন ওদের দিয়ে কোন কাজ করানোর পক্ষে নন সাধনা চাকমা। তার মতে ওরা এখন পড়ালেখা করে নিজেদের তৈরি করবে, এরপর সন্তানরাই চাকরি করে তাদের চালাবে।
সাধনা চাকমা চান তার সন্তানরা ডাক্তার হয়ে সমাজ ও দেশের সেবার পাশাপাশি বাবা মাকেও দেখবে, তবেই তার স্বপ্ন পূরণ হবে। তিনি চাননা তার সন্তানরা কোন রাজনীতি করুক।
শান্তি চাকমার দু মেয়ে, বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, তবে সেটা একটু কম বয়সেই, সেটা অবলীলায় স্বীকার করে নিয়ে এটাও জানালেন ছোট মেয়ের ক্ষেত্রে এ ভুল করবেনা। সে এবার ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠবে। এই মেয়েকে নিয়ে স্বপ্নে বিভোর তিনি, মেয়ে ইউনিভার্সিটিতে পড়বে, বড় সরকারি চাকরি করবে।
তবে তার ধানি জমি একেবারেই কম, তাই স্বামি স্ত্রী মিলে জুম চাষ করেন। তবে এতে এখন জীবন চালানো অনেক কঠিন মন্তব্য করে তিনি বলেন, একটু সুখের আসায় বাড়ি থেকে চার কিলোমিটার হেঁটে এসে তারপর গাড়ি যোগে বনরূপা বাজারে আসি, প্রতিদিন একশ টাকা গাড়ি ভাড়া খরচ হয়। বিভিন্ন সবজি কিভাবে সংগ্রহ করেন জানতে চাইলে বলেন, তিনি বাজারে আসেন আর স্বামী পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বিভিন্ন সবজি সংগ্রহ করেন, আর গ্রাম থেকে কিনে এনে বাজারে বিক্রয় করেন, তাই তিনি প্রতিদিন বাজারে আসতে পারেননা, সপ্তাহে চারদিন আসেন।
এক পণ্য বিভিন্ন দামে বেঁচা প্রসংগে তিনি বলেন, আমরা অনেক দুর থেকে বাজারে আসি, বেঁচাকেনা করি, আমাদের সব কিছু গাড়ির ওপর নির্ভর করে, যেদিন এলাকার গাড়ি থাকে সেদিন ভালো দামে বেঁচতে পারেন, আর এলাকা গাড়ি না থাকলে তাড়াতাড়ি বেঁচে চলে যেতে হয়, সেদিন লাভ কম হয়।
তিনি আরও বলেন আমরা কষ্ট করি কিন্তু প্রকৃত দাম পাইনা, অথচ বেপারিরা আমাদের থেকে কিনে আমাদের সামনেই প্রায় দ্বিগুন দামে বেঁচেন, কারণ তাদের তাড়া নেই বাড়ি যাবার, আমাদেরতো এলাকার গাড়ি না থাকলে সন্ধ্যা আগেই চলে যেতে হয়।
শান্তি চাকমার শেষ কথাটি ছিলো-‘আমরা মাটির মানুষ, মাটিতে থাকি ভাগ্য বদলাতে, জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি, তাই হয়তো বিধাতার এমন বিরূপ আচরণ।’