আলাউদ্দিন শাহরিয়ার, বান্দরবান
পাহাড়ে আধিপাত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে টার্গেট কিলিং মিশনে নেমেছে সশস্ত্র সস্ত্রাসী গ্রুপগুলো। এদিকে ‘জনসংহতি সমিতির’ গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মগ লিবারেশন পার্টি (এমএলপি) বাহিনী প্রধানের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। জেলায় বান্দরবান সদর, রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা, আলীকদম এবং নাইক্ষ্যংছড়ি সাতটি উপজেলায় পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), জনসংহতি সমিতি (এমএনলারমা), ইউপিডিএফ (প্রসিত খীসা), ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক), মগ লিবারেশন পার্টি (এমএলপি) এবং ম্রো ন্যাশনাল পার্টি (এমএনপি)সহ বিচ্ছিন্ন আরও কয়েকটি সশস্ত্র গ্রুপের তৎপরতার খবর জানা গেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত রোববার রাতে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এবং মগ লিবারেশন পার্টির (এমএলপি) দুপক্ষের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে রোয়াংছড়ি উপজেলার তারাছা ইউনিয়নের কেচালং মৌজায়। গোলাগুলিতে মগ লিবারেশন পার্টির বান্দরবান অঞ্চলের প্রধান ক্রয়হ্লা রাখাইন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত অবস্থায় মারা গেছে বলেও খবর পাওয়া গেছে। মগ বাহিনীর আরও ৬ জন সদস্য গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছে বলেও জানিয়েছেন পাড়াবাসী। এদিকে, পাল্টাপাল্টি গোলাগুলি এবং হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে আশ-পাশের পাহাড়ি গ্রামের মানুষ।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) বান্দরবান জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অংচ মং মারমা বলেন, অধিকার আদায়ের সংগ্রামের নামে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে পাহাড়ের সশস্ত্র গ্রুপগুলো। চাঁদাবাজি, হত্যা, অপহরণ এগুলো নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে পাহাড়ে। সংঘাতে পাহাড়িরাই মরছে একে-অপরের গুলিতে। পাহাড়ের মানুষরা এখন শঙ্কিত, আতঙ্কিত। নিরাপদে ঠিকমতো সবখানে চলাফেরাও করতে পারছেনা। সশস্ত্র গ্রুপগুলো পাহাড়ে উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। চাঁদা ছাড়া পাহাড়ে কোনো উন্নয়ন কর্মকা-ই বাস্তবায়ন করা যাচ্ছেনা। এগুলো পার্বত্যবাসীকে আরও পেছনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এগুলো বন্ধে সরকারকে আলোচনার পাশাপাশি আরও কঠোর হতে হবে।
পার্বত্য নাগরিক পরিষদের সভাপতি কাজী মুজিবুর রহমান বলেন, অস্ত্রের ঝনঝনানি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বান্দরবান। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি জেলা হিসাবে পরিচিত বান্দরবান হঠাৎ করেই সন্ত্রাসীদের সংঘাতের জেলায় পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সংঘাত এবং পরিকল্পিত হহত্যাকাণ্ডে ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে বান্দরবান। পাহাড়ে শান্তি ফেরাতে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের বিকল্প নেই।
এদিকে, আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর তথ্যমতে, সাম্প্রতিক সময়ে বান্দরবান জেলায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে ৩১ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে। তন্মধ্যে গতমাসের ২৬ ফেব্রুয়ারি রোয়াংছড়িতে জেএসএসের (সন্তু লারমা) সদস্য মংসিংশৈ মারমা (৪০) গুলি করে হত্যা করা হয়। রুমায় ৩ ফেব্রুয়ারি গোলাগুলিতে সেনা কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান এবং ৩ সশস্ত্র সন্ত্রাসীর মৃত্যু হয়; তিন সন্ত্রাসীকে জেএসএসের কর্মী হিসেবে চিহ্নিত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর আগে ৪ জানুয়ারি লামায় রূপসীপাড়ায় শশুর বাড়িতে বেড়াতে গেলে মগ বাহিনীর সদস্য মংক্যচিং মারমা (৩৫) গুলি করে হত্যা করা হয়।
আবার ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর রাজবিলা ইউনিয়নের রমতিয়া পাড়া থেকে মগ বাহিনী কিরণময় তঞ্চঙ্গ্যা (২৬) অপহরণ করে হত্যা করা হয়। ১৮ ডিসেম্বর অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের গুলিতে বোধিপ্রিয় চাকমা (৩৮) নামে এক পল্লী চিকিৎসক আহত হয়, ১৩ ডিসেম্বর রাজবিলায় জেএসএসের সদর উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক পুশে থোয়াই মারমা (৩৬) গুলি করে হত্যা করা হয়। ২৩ নভেম্বর তারাছা ইউনিয়নের তালুকদার পাড়ায় আওয়ামীলীগের কর্মী উথোয়াইনু মারমাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ১৮ সেপ্টেম্বর নাইক্ষ্যংছড়িতে নিরাপত্তাবাহিনীর সঙ্গে গোলাগুলিতে ১ সন্ত্রাসীর মৃত্যু হয়, ১ সেপ্টেম্বর কুহালং ইউনিয়নে ভ্রমণকারী মগ বাহিনীর স্বজনদের গাড়িতে ব্রাশফায়ার করে সন্ত্রাসীরা, ৭ আগস্ট কুহালং ইউনিয়নের আওয়ামীলীগ নেতার ভাই উসাই মং (৩৪) অপহরণ করে হত্যা করা হয়। ১৯ জুলাই কুহালং ইউনিয়নে আওয়ামীলীগের সদস্য অংক্যথোয়াই (উগ্য) মারমা (৫০) অপহরণ করে হত্যা করা হয়।
বান্দরবানের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা পুলিশ সুপার জেরীন আখতার বলেন, একের পর এক হত্যাকা-গুলো হচ্ছে রি-অ্যাকশন। সশস্ত্র গ্রুপগুলো হত্যাকাণ্ডের বদলা পাল্টা হামলা চালাচ্ছে। হঠাৎ করেই সশস্ত্র গ্রুপগুলো সক্রিয় হয়ে উঠেছে বান্দরবান। এত দিনের ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন ছিলো। কিন্তু বর্তমানে সশস্ত্র গ্রুপগুলোর প্রতিটি হত্যাকা- এবং হামলা একই সুতোয় বাঁধা মনে হচ্ছে। আমরা সুনির্দিষ্ট তথ্যগুলো সংগ্রহ করে অভিযান তৎপরতা চালাচ্ছি।