পাহাড়ি জনপদ বান্দরবানের লামা উপজেলা। এখানকার ছোট-বড় পাহাড়ে জনবসতির ইতিহাস সেই অনন্ত কালের। পাহাড়ী জনগোষ্টির পরম্পরায় চলে আসা জীবন-যাপন, জীবিকার আদিম ও সনাতনী জুমচাষের সুবাদে শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ পাহাড়ের চূড়া, পাদদেশ ও কোলঘেঁষে বসবাস করে আসছে। সে সাথে সমতলের নদী ভাঙ্গা ও ভুমিহীন শ্রমজীবী বাঙ্গালীরা ৫০-৬০ বছর যাবত পাহাড়ের অনাবাদি ও সরকারের খাস জমিতে বসতি স্থাপনের পাশাপাশি কৃষি উৎপাদনের জন্য পাহাড় কেটে-খুড়ে আবাদি জমি তৈরী করে জীবন-যাপন করে আসছে। বর্তমানে বর্ষা মৌসুম এলেই এ অঞ্চল পরিণত হয় আতঙ্কের জনপদে।
জানা যায়, সাম্প্রতিক টানা কয়েকদিনের মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাতে শহর এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধস শুরু হয়। এতে গত মঙ্গলবার পাহাড় ধ্বসে উপজেলার সরই ইউনিয়নের কালাইয়াপাড়ায় এক পরিবারের ৩জনের মৃত্যু হয়েছে। এখনিই পাহাড়ের মৃত্যুঝুঁকিতে বসবাসকারি পরিবারকে নিরাপদে সরিয়ে না নেয়া হলে, আবারো পাহাড় ধসে প্রাণহানিসহ মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
উপজেলায় পরপর কয়েক বছর যাবত পাহাড় ধস ট্রাজেডির কারণে এখন পাহাড় দেখলে সবাই আঁতকে উঠলেও এখনও পাহাড়ে রয়ে গেছে হাজার হাজার পরিবার। একের পর এক পাহাড় ধসে প্রাণহানির মত মানবিক বিপর্যয় ঘটলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি পরিকল্পিত বসবাস কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারিদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ। তবে পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাসকারিদের উপজেলা প্রশাসন ও পৌরসভার পক্ষ থেকে মাইকিং করে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে বলা হয়। কিন্তু এখনো কেউ নিরাপদ স্থানে সরে যায়নি ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীরা। ঝুঁকিতে থাকা পরিবারগুলোর স্থায়ী পুনর্বাসনের ব্যাপারে উদ্যোগ নেই কোনো সংস্থার।
জরিপে জেলার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে বসবাসকারী লামা উপজেলা হলেও পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে বসবাসরত পরিবারগুলোর কোনো নির্দিষ্ট তালিকা নেই প্রশাসনের কাছে। এছাড়াও দাতা সংস্থাগুলো বিশেষ করে ইউএনডিপি, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ প্রতি বছর হাজার কোটি টাকা তথাকথিত উন্নয়নের নামে ব্যয় দেখিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বর্ষাকালে ভয়াবহ পাহাড় ধস ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় দুর্যোগ মুক্ত বিষয়ে মানবিক সহায়তা হিসেবে কোনো ধরনেরই আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপনের কর্মসূচি নেই এসব সংস্থার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার আজিজনগর, ফাইতং, সরই, রুপসীপাড়া, সদর, গজালিয়া ও ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ি এলাকার পাহাড় কেটে অপরিকল্পিতবাবে ঘরবাড়ি তৈরি করে বসবাস করে আসছে তিন হাজারেরও বেশি পরিবার। আবার পৌরসভা এলাকায়ও রয়েছে ১হাজারের বেশি পরিবার পাহাড় ধ্বসের ঝুঁকিতে। তাদের বেশিরভাগই হতদরিদ্র মানুষ। স্থায়ীভাবে পুনর্বাসন করা না হলে, পাহাড় ছাড়তে নারাজ এসব ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারী পরিবারগুলো।
লামা পৌরসভার বাসিন্দা জামাল, আনোয়ার হোসেন, বদিউর রহমান জানায়, আমরা গরীব মানুষ, এখানে সমতলের জমির দাম আকাশ ছোঁয়া। এত দামে আমাদের পক্ষে জমি কেনা অসম্ভব। পাহাড়ের জমি সমতল ভুমির চেয়ে অনেক সস্তা। তাই পাহাড়ের জমি কিনে বসবাস করছি। সচেতন মহল জানিয়েছেন, উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের পাহাড়ে অতিঝুঁকি নিয়ে বসবাসকারী এসব পরিবারে যে কোন সময় বড় ধরণের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। তারা শুধু মৃতুঝুঁকিতে বসবাস করছে তা নয়, জীবন যাত্রায় পানি, আবহাওয়া, সামাজিক পরিবেশ, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ সুবিধাসহ নাগরিক কোন প্রকার সুবিধা এরা ভোগ করতে পারছে না। সরই ইউনিয়নে ধ্বসের ঘটনার পর পাহাড়ে ঝুঁকিতে থাকা এসব মানুষগুলোর পাশাপাশি উপজেলা ও পৌরসভা প্রশাসনও উদ্বিগ্ন।
ফাইতং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. জালাল উদ্দিন ও সদর ইউপি চেয়ারম্যান মিন্টু কুমার সেন বলেন, অভাবি মানুষের পক্ষে সমতলে বসতি গড়ার সামর্থ না থাকায় পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসতি গড়ছে। তবে ঝুঁকিপুর্ণ পরিবারগুলোকে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয়ার জন্য দফায় দফায় তাগিদ দেওয়া হচ্ছে।
লামা পৌরসভার মেয়র মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, পৌরসভা এলাকায় যারা পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন তাদেরকে নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার জন্য বার বার মাইকিং এর মাধ্যমে তাগাদা দেয়া হচ্ছে। এছাড়া আশ্রয় কেন্দ্রে খোলার পাশাপাশি আশ্রয়গ্রহিতাদের জন্য খাবার, পানি ও তাদের বাড়ি পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও কেউ যেতে চায় না।
বান্দরবান মৃত্তিকা ও পানি সংরক্ষণ কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. মাহবুবুল আলমের মতে, অবাধে পাহাড় থেকে বৃক্ষ নিধন, পাথর উত্তোলন, পাহাড়ে উপযুক্ত চাষাবাদ পদ্ধতি অনুসরণ না করে জুম চাাষ, পাহাড় কেটে ইটভাটা স্থাপনসহ প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি করায় পাহাড়গুলো ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। তাছাড়া এখানকার পাহাড়গুলো পাললিক শিলা দ্বারা গঠিত। যা সহজেই ভঙ্গুর প্রকৃতির। তাই ভারী বর্ষণ হলেই পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, গত তত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে পাহাড় ধসের ঘটনার পর পরই প্রশাসন এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা পাহাড়ের ঝুঁকিপুর্ণ বসতঘরগুলো সরানোর উদ্যোগ গ্রহণের পর সরকার পরিবর্তন ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সমন্বয়ের অভাবে তা আর বেশিদূর এগোয়নি। প্রতিবছর বর্ষা এলেই প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সংশি¬ষ্ট কর্তৃপক্ষ পাহাড়ে ঝুকিপুর্ণদের নিরাপত্তার তাগিদ দিয়ে অফিসের দায়সারা রুটিন ওয়ার্ক শেষ করেন। পাহাড়ে বসবাসকারীদের নিরাপদ আশ্রয়ে পুর্ণবাসনের কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার ভুক্তভোগীরা জোর দাবি জানিয়েছেন। উল্লেখ্য, পাহাড় ধসে ২০০৯ সালে আজিজনগর ও গজালিয়ায় এক পরিবারের ৬জনসহ ১১ জন, ১৯৯৬ সালে পৌর এলাকার রাজবাড়িতে একই পরিবারের ৭জন, ২০১২ সালের ২৭ জুন রাতে ফাইতং ইউনিয়নে ২৫ জন, রুপসীপাড়া ইউনিয়নে ২জন ও সদর ইউনিয়নে ২ জন, ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই লামা সদর ইউনিয়নে ৬জন এবং সর্বশেষ গত মঙ্গলবার সরই ইউনিয়নের কালাইয়া পাড়া ৩জন মারা যান।
এ বিষয়ে লামা উপজেলা নির্বাহী অফিসার নূর-এ-জান্নাত রুমি বলেন, পাহাড়ে ঝুঁকিপুর্ণ বসবাসকারীদেরকে নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং এর মাধ্যমে বারবার তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃপক্ষকেও ঝুঁকিপুর্ণ বসবাসকারীদেরকে নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য তাগিদ দিতে বলা হয়েছে। এর পরও সরে না গেলে প্রশাসন কঠোরতা অবলম্বন করবে।
Previous Articleরাবেতা কলেজে নবীনবরণ
Next Article কাউখালীতে পাহাড়ি নারীকে ধর্ষণ, থানায় মামলা