রাঙামাটি শহরের ওমদামিয়া পাহাড়েই নিজ নিজ পরিবারের সাথে থাকতেন রূপা ও জুয়েল। একই পাড়ায় কাছাকাছি বাড়িতেই ছিলো বসবাস। রূপার বাড়ি থেকে এইতো চার-পাঁচটি বাড়ির পরেই ছিলো জুয়েলের বাড়ি। আগেই বলে রাখি জুয়েলের বাবার বাড়ি খুলনায় আর রূপা কিন্তু রাঙামাটিরই মেয়ে ছিলো প্রিয় পাঠকেরা।
রূপা ছিলো জুয়েলের ছোট বোনের বান্ধবী। রোজই তাদের দেখা হতো, কথা হতো। কিন্তু হঠাৎ একদিন রূপা বাড়ির সামনে বাগানে কাজ করতে থাকে তখনি সে পথে যাচ্ছিলো জুয়েল। হঠাৎ থমকে যায় সে, এতদিন যে নারীকে সে দেখে আসছিলো, তাকেই যেনো অন্য রকম লাগছে আজ। থমকে যাওয়া জুয়েলের মনে কি যেনো হচ্ছিলো ! এ কেমন অনুভূতি, একি অন্য রকম ভালোলাগা, একি কোন ভালোবাসা নয়তো ?
ক্লাস নাইনে পড়া জুয়েলের হঠাৎ অষ্টম শ্রেণিতে পড়া রুপার প্রতি ভালোলাগার অন্যরকম অনুভুতি শুরু হয়। তার কাছে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে জুয়েলের মন ও প্রাণ। হবে কি তার মনের মানুষের সাথে সাক্ষাৎ ? বলতে পারবে জুয়েল তার মনের মাঝে লুকানো হাজারো কথা? পারবে কি বলতে সকল বাঁধাকে দূরে রেখে তার মনের কথাগুলো ? রবি ঠাকুরের মত জুয়েল কি রুপাকে বলতে পারবে ‘ভালোবেসে সখী, নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো-তোমার মনের মন্দিরে’।
এমনই শত চিন্তায় সময় পেরিয়ে যায়। একদিন জুয়েল তার ছোট বোনকে দিয়ে ডেকে আনলো রূপাকে। খুলে বসলো তার মনের মাঝে লুকানো কথার ঝুড়ি খানা। এক পর্যয়ে রুপাকে বলেই ফেলো তার মনের কথা। কিন্তু রূপার পরিবার মেনে নিবে না এ অজুহাতে দূরে সরে যাওয়ার বাহানা।
সেই ১৯৯২ সালের কাহিনী, যখন জুয়েল রূপাকে ভালোবাসার মায়ার জালে বেঁধে নিয়েছিলো। এ থেকে তাদের রোজ দেখা করা, কথা বলা,কতই না মজার ঘটনা। রোজই জুয়েল রূপাকে দেখতো তার বাড়ির আশপাশে ঘুরে ঘুরে। জুয়েল যখনই সাইকেল নিয়ে বের হতো তখনি রূপার বাড়ির সামনে গিয়ে বেল বাজিয়ে জানান দিতো ‘আমি এসেছি, ময়াবি রাজ্যের রাজ কুমারীর প্রাসাদের সামনে। এই বুঝি রাজকুমরী প্রসাদ ছেড়ে বেরিয়ে আসবে। বলবে কোন রাজ্যের রাজকুমার গো আমায় নিয়ে পারি দেবে বুঝি দূর কোন পররাজ্যে।’
ভালোবাসার মাঝে শত ঘটনা রয়েছে তাদের, ঠিক তেমনি সেই একি দনকার কথা। জুয়েল ও রুপার বন্ধুরা ঠিক করলো তারা সকলে চঁড়–ইভাতি খেলবে আসামবস্তি গ্রামে। যেমন কথা তেমনি কাজ। চড়ুইভাতি খেলার দিন ঠিক হলো, সকলে মিলে খেলতে গেলো চঁড়ুইভাতি। ব্যাকুল জুয়েলের মন অবুঝ রূপার মনকে যেনো বারবার টেনে আনছে তারই কাছে। তাইতো বন্ধুদের দূরে রেখে তারা দুজনে আপন মনে গাছের নিচে মনের শত অংকের সমাধান খুঁজে নিতে মনের খাতা খুলে বসেছে। হঠাৎ তখনি বন্ধু এসে জানান দিলো রূপার ভাই এসেছে আদরের বোনটিকে খুঁজতে, এই কথা শুনে জুয়েল এবার লুকায় কোন দিকে। বনের মাঝে জুপে-ঝাঁড়ে লুকায় সে চুপটি করে।
ভাই বোনকে দেখার পরে চলে যায়, তখন বন্ধু সকলে খুঁজতে থাকে জুয়েলকে। কোথায় সে ? পায় না খুঁজে কেউ। হঠাৎ সে জঙ্গল থেকে ভূতুরে চেহারা নিয়ে বেড়িয়ে আসে। চিনতে পারার কোন উপায় নেই জুয়েলকে। সবাই যেনো অবাক কিন্তু প্রেমী মন রুপার সে যে ভালোবাসাময় অনুভূতি।
এভাবে চলতে থাকে রূপা-জুয়েলের প্রেম গল্প। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ভালোবাসার পরে এসএসসি পাস করে জুয়েল রুপাকে পাওয়ার তীব্র পণে বেরিয়ে যায় জীবনের লক্ষ্য পূরণে। চট্টগ্রাম ও ঢাকায় থেকে স্বপ্ন পূরণের জন্যে চলে তার অবিরাম পরিশ্রম। ১৯৯৪ সালের পরে প্রায় সাত মাসের মত তাদের কোন দেখা ও কথা হয়না। এনিয়ে তীব্র অভিমান জমে রূপার মনে, তবে চেষ্টা কোন কমতি রাখে নি জুয়েল। হঠাৎ এক ঈদে জুয়েল ছোট ভাইকে নিয়ে ঈদ করতে এলো তার প্রেমের শহর রাঙামাটিতে। ঈদের দ্বিতীয় দিন রুপার এক বন্ধুর বাড়িতে দীর্ঘ অপেক্ষার পরে দেখা মিলে এ যুগলের। তীব্র অভিমান সাথে কিছুটা ক্ষোভ, যাকে বলে ভালোবাসার ঝগড়া, এনিয়ে ঘন্টা খানিক চলে তাদের ভালোবাসার মিষ্টি ঝগড়ার পর্ব। এ থেকে ভালোবাসার পথ চলা নতুন করে শুরু আর বাঁধা দেওয়ার সাধ্য কার, ১৯৯৯ পর্যন্ত চিঠি ছিলো তাদের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। প্রায় চিঠি রূপা পেলেও পেতো না কয়েকটি চিঠি, যা এলাকার ছেলেরা পোষ্টমাস্টার থেকে নিয়ে নিতো। কিন্তু প্রেমে যেনো ভাটা পরবার নয়। তীব্র বিশ^াস ও ভালোবাসার মায়ায় তাদের টিকিয়ে রেখেছিলো শেষ পর্যন্ত। এইতো কয়েকটি ঈদ ও ২৮ ডিসেম্বর ছিলো তাদের মিলনের পবিত্র দিন। এ দিন গুলোর জন্যে অপেক্ষায় থাকতো উভয়ে কবে আসবে প্রিয় মানুষটি। কবে বলা হবে মনে মাঝে জমানো হাজার কথা। শত প্রতিকূলতার মাঝেও টিকে ছিলো তাদের বিশ^াসের উপরে ভর করা প্রেম কাহিনী।
এভাবেই চলতে থাকে এ যুগলের প্রেম। ১৯৯৯ সাল দীর্ঘ প্রায় আট বছর চলতে থাকে তাদের প্রেম। রূপা তখন ডিগ্রিতে অধ্যায়নরত ছাত্রী। জুয়েল এরমধ্যে পরিবারকে রাজি করিয়ে রুপাদের বাসার বিয়ের প্রস্তাব পাঠায় প্রথমে সব ঠিক থাকলেও পরে জুয়েলের পরিবার ঢাকা স্থায়ী ভাবে বাস করায়, রুপার পরিজনরা জুয়েলের বাড়ি ঢাকা থেকে ফিরে দূরে বলে বিয়ে দিতে রাজি হয় না। যাকে চট্টগ্রাম ভাষায় বলে ‘বিদেশিত্তে পুয়ার হাছে মায়াপুয়া বিয়ে ন দিয়ুম, মায়পুরা দেহিত পাইজ্জুম না, এত দূরে বিয়ে দিলি’।
অবুঝ ভালোবাসার মন রূপার। প্রিয় মানুষের সাথে বিয়ে দেবে না পরিবার। অন্য জনের সাথে ঘর করতে হবে তার, এ কেমন বিচার। যার জন্যে মনের মাঝে ঘর বেঁধে রেখেছে সে, তাকে পাবে না, হতে পারে কি?
অভিমানী মেয়ে বুকের কষ্ট বুকে জমা রেখে চিঠি লিখে পাঠালো জুয়েলের কাছে। জুয়েল চিঠি পেয়ে একবন্ধুকে সাথে নিয়ে চলতে আসলো রাঙামাটিতে। প্রিয় মানুষের ডাক, না এসে পারে কোন তৃষ্ণার্ত প্রেমিক হৃদয়। আসার সময় বাড়িতে বলে আসে রূপাকে নিয়েই বাড়ি ফিরবে সে।
রাঙামাটি এসে বনরুপা নেমে একটি দোকানে বসে রইলো জুয়েল। তখনই দেখা মিলে রুপার এক বন্ধুর সাথে তাকে দিকে প্রাইভেট পড়ার কথা বলে বের করে আনে রুপাকে। রুপার ভাইরা যদি জানতে পেতো তবে কিনা করতো জুয়েলকে। কারণ তারা ছিলো সে সময়ের রাঙামাটির বড় নেতা। কিন্তু পাগল প্রেমিক মন শত ভয়কে দূর করে রুপাকে নিয়ে বেরিয়ে পরলো নতুন ঠিকানার খোঁজে। বন্ধুরা সাথেই ছিলো তাদের, রাঙামাটি থেকে বেরিয়ে জুয়েল রুপার বন্ধুদেরকে পাঠিয়ে দিলো রাঙামাটিতেই। আর অন্যদিকে সে ও তার ঢাকা থেকে আসা বন্ধু এবং প্রিয়তমা রুপাকে নিয়ে বেরিয়ে পরলো চট্টগ্রামের উদ্যোশে। চট্টগ্রামে পৌঁছানোর পরে ঢাকায় যাওয়ার জন্যে রাতের টিকেট কাটলো তারা। সময়তো সে অনেক দেরি, তাই তারা চট্টগ্রামে রিক্সা নিয়ে ঘুরলো বেশ কিছুটা সময়। পরে রাতে ঢাকার গাড়িতে উঠে রওনা হলো ঢাকার পথে। নামবে তারা গাবতলি কিন্তু তারা এর আগের স্টেশনে নেমে পরলো। কারণ ইতিমধ্যে নিশ্চয় রুপার বাড়ির সবাই খুঁজতে শুরু করেছে রুপাকে। যে কোন স্থানেই ধরা পড়ার সম্ভবনা রয়েছে তাদের। সেখান থেকে জুয়েলের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুললো রূপাকে। পরের দিন জুয়েলের ছোট চাচার বাড়িতে মিলন হয় এ যুগল প্রেমিকের। স্বপ্ন নিয়ে বেরিয়ে আসা রুপা খুঁজে পায় তার প্রেমিক জুয়েলকে।
প্রায় মাস তিনএক পরে রুপার পরিবার ঢাকায় খোঁজ খবর নিয়ে রূপাকে আনতে যায় কিন্তু রূপা ও জুয়েল ঢাকার বাইরে থাকায় দেখা মিলে না তাদের। পরে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে তারা। এমধ্যে রূপার সাথে তার বোনের কয়েকটি চিঠি আদান প্রদান ছিলো।
জুয়েল নতুন বউকে ঘরে রেখে চলে আসে চট্টগ্রামে কাজের খোঁজে। কারণ রুপাকে বিয়ে করার জন্যে এতটা ব্যস্ত ছিলো সে, চাকরিটা হারাতে হয় শেষে।
এর মধ্যে কেটে যায় প্রায় বিয়ের নয় মাস। পরে এক ঈদের সময় রুপাকে নিয়ে দুঃসাহসের সাথে জুয়েল চলে আসে রাঙামাটিতে। রূপার পরিবার পরিজনদের সাথে দীর্ঘ সংগ্রামের পর পারিবারিক ভাবে সম্পন্ন মিলনে সম্ভব হয় এই যুগল প্রেমিকের ভালোবাসা।
দীর্ঘ বছর পরে গত ৮ ফেব্রুয়ারি কথা হয় এ যুগল প্রেমিকের সাথে। তারা বর্তমানে রাঙামাটি শহরের আলমডক ইয়ার্ড আবাসিক এলাকায় বসবাস করেন। বিয়ের প্রায় ১৮ বছর পার করেছে তারা। প্রেম ও বিয়ে মিলে প্রায় ২৬ বছরে তাদের প্রেম কাহিনী। জুয়েল এখন বনরূপা মসজিদ মার্কেটে দোকান দিয়েছে। অন্যদিকে রুপা এখন প্রায় ব্যস্ত সময় পার করে সংসারের কাজে। তাদের ঘরে দুইটি সন্তান, জুঁই ও ঐশি। তাদের নিয়েই চলছে এ যুগল প্রেমিকের ভালোবাসার স্বপ্নের সংসার।
বর্তমানের ভালোবাসা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয় এ সফল দুই যুগল প্রেমিককে। তারা বলেন, বর্তমানে প্রিয় মানুষের সাথে যোগাযোগ করার মাধ্যম সহজ হওয়ার ভালোবাসার যে আনন্দ তাই হারিয়ে যেতে বসেছে। প্রিয় মানুষের একটি চিঠির জন্য বহুদিন অপেক্ষা করা, দেখা করার জন্যে মন উতলা হওয়া, এখনের জন্যে কোন বিষয়ই না। প্রযুক্তির কল্যাণে অতি সহজেই কথা বলা ও দেখা করা সম্ভব হচ্ছে বলে প্রেম গুলো দীর্ঘ হচ্ছে না, বলে মন্তব্য করেন এই সফল যুগল।
৯ Comments
সুন্দর দাদা
ভালোবাসা দূর আর কাছের কোন পার্থক্য বুঝে না
অসাধারণ ভালবাসা
জুয়েল ভাই আর ভাবীকে ভালভাসা দিবসে সালাম এবং শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। জুঁই ও ঐশীর প্রতি স্নেহ আর সবার জন্যশুভ কামনা থাকলো।।। বিশেষ ধন্যবাদ পাহাড় এবং পাহাড়ের স্বপ্নদ্রষ্টা এলাহি ভাইয়ের প্রতি।।।
Thanks ভাই
রূপার আন্টির বাসাইতো সবাই বিশ্ব প্রেমিক। প্রেম ছাড়া কিছুই বুঝে না। তাদের পরিবারে এখন যে গুলো বিরাজমান আছে,সেগুলোতো প্রেমের জন্য গিনেসরেকর্ড করবে।
Oh my !! Amader pasher bashar aunty ??
ল্যানি ফ্যাশনে সেদিন যদি জুয়েল নামের সে ছেলের সাথে আমার দেখা হতোলল তাহলে হয়ত তাদেরকে পালিয়ে বিয়ে করতে হতো না পারিবারিকভাবে সুন্দর একটি পরিনয় হতো। কিন্তু ঢাকা ইপিজেডের মেয়েদের ধাক্কা খেয়ে বৃষ্টিতে ভিজেও ২ হাজার ২ হাজার ৪ হাজার কর্মচারীর মাঝে জুয়েলকে খুজে বের করতে না পারায় হয়ত তাদের সেই বাস্তব গল্প সবাই জানতে পেরেছে ভালোবাসার গল্প হিসেবে।
সেটলার কাঙালিদের কি আবার ভালোবাসা