শ্যামল রুদ্র, রামগড় ॥
বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু-১ ইতিমধ্যেই উদ্বোধন হয়েছে। এখন দু’দেশের জনগণ চাচ্ছেন দ্রুততম সময়ের মধ্যে রামগড় স্থলবন্দরের পূর্ণাঙ্গ রূপ। এটি আন্তঃদেশীয় যোগাযোগ বাড়িয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে। খুলে যাবে অর্থনীতির নতুন দুয়ার। রামগড় মহামুনি এলাকায় বন্দর স্থাপনে চলছে পুরোদমে কাজ। উভয় দেশে পারাপারের জন্য মৈত্রী সেতু-১ এখন প্রস্তুত। ফেনী নদীর রামগড় অংশে এটি নির্মিত। এই প্রথম কোন নদীতে সেতুর সাহায্যে বাংলাদেশ-ভারত সংযোগ স্থাপন হলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গত ৯,মার্চ ’২১ ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে মৈত্রী সেতুর উদ্বোধন করেন। প্রধানমন্ত্রী ওই সময় বলেন,“রাজনীতির সীমারেখা বাণিজ্যে বাধা হতে পারে না, শুধু চট্টগ্রাম পোর্ট নয়, চট্টগ্রাম বিমান বন্দরও ত্রিপুরাবাসী ব্যবহার করতে পারে’। একই অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এটিকে ‘দুই দেশের নতুন বাণিজ্য করিডোর’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন।
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রকল্প পরিচালক (যুগ্ম সচিব) সারোয়ার হোসেন এই প্রতিবেদককে বলেন, ইমিগ্রেশন কার্যক্রম আগামী ছয় মাসের মধ্যে চালু করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আশা করছি সহসাই উভয় দেশের জনগণ এই রুট ব্যবহার করে আসা-যাওয়া করতে পারবে। পূর্ণাঙ্গভাবে বন্দর চালু হওয়ার আগেই এটি হবে।
যে কারণে, এই স্থলবন্দর ঘিরে অর্থনৈতিক মুক্তির প্রত্যাশা করছেন এ অঞ্চলের মানুষ। খেটে খাওয়া, উচ্চ ও মধ্যবিত্ত সব শ্রেণি-পেশার মানুষের আশা রামগড় স্থল বন্দর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টি করবে সর্বত্র। বৈদেশিক বাণিজ্যে এগুবে দেশ, সফল কানেক্টিভিটিতে যুক্ত হবে নতুন এক সোনালী অধ্যায়ে। দেশের অন্য অঞ্চলের তুলনায় পাহাড়ের মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ কম। বড়, ছোট কোন ধরনেরই কল কারখানা না থাকায় অসংখ্য মানুষ অত্যন্ত কায়ক্লেশে জীবন যাপন করছেন।
নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ১৪,ফেব্রুয়ারী বন্দরের চলমান কাজ পরিদর্শনকালে বলেন, ‘মৈত্রী সেতুর মাধ্যমে ভারতের ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হলে দুই দেশের মধ্যে ব্যবসায়, বাণিজ্য ও পর্যটন শিল্পের প্রসার এবং মানুষে মানুষে সম্পর্কোন্নয়নে গোটা অঞ্চলের উপকার হবে।’ তাইতো নতুন আশায় উজ্জীবিত এ সব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসহ বিনিয়োগকারী-ব্যবসায়ীরা। বিপুল সংখ্যক মানব সম্পদ কাজে লাগবে অযুত সম্ভাবনার এই কর্মযজ্ঞে। ওই সময় চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যে খুলে যাবে নতুন দুয়ার, যেন বহুবছরের প্রত্যাশিত চাওয়া। বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুনশি সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন,“চট্টগ্রাম বন্দরকে পূর্ব ভারতের কমপক্ষে পাঁচ কোটি মানুষ ব্যবহার করবে। তখন প্রচুর রাজস্ব আয় হবে। ব্যবসা-বানিজ্য সম্প্রসারিত হওয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থান বাড়বে। উত্তর-পূর্ব ভারতের পণ্য আনা-নেওয়ার জন্য কলকাতা বন্দরে যেতে ১২শ কিলোমিটার পাড়ি দিতে হয় অন্যদিকে চট্রগ্রাম বন্দরের দূরত্ব অনেক কম।” ভারতীয় পর্যটকেরা সময় ও অর্থ বাঁচিয়ে পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার ভ্রমণের সুযোগ পাবেন। আবার চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের লোকজনও সহজেই সেভেন সিস্টার্স বেড়াতে পারবেন।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা নয়াদিল্লিতে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ ও ‘অ্যাক্ট ইষ্ট পলিসি’র প্রভাব বিষয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছেন, ‘ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির বীজ নিহিত আছে প্রতিবেশী বাংলাদেশের সহযোগিতার ওপরই। ‘সেভেন সিস্টার্স’ হিসাবে পরিচিত এই অঞ্চলের স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে।’
রামগড় পৌরসভার মেয়র রফিকুল আলম কামাল বলেন, চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরকে ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ত্রিপুরা রাজ্যসহ মেঘালয়, আসাম, মনিপুর মিজোরাম, নাগাল্যান্ড এবং অরুণাচল এই সাত রাজ্যের (সেভেন সিস্টার্স) সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে বাংলাদেশ ও ভারত সরকার রামগড়-সাবরুম স্থল বন্দর স্থাপনে উদ্যোগী হয়। বন্দর চালু হলে দুদেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে নতুন দিগন্ত উম্মোচন হবে। অর্থনৈতিকভাবে এ অঞ্চল হবে সমৃদ্ধ। যদিও রাজনৈতিক ও নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এ প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন থমকে ছিল। বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বর্তমান সরকারের আন্তরিক উদ্যোগে বাস্তবে রূপ নিয়েছে বহুকাক্সিক্ষত রামগড়-সাবরুম স্থলবন্দরের দৃশ্যমান অবকাঠামো। ভারত সরকার ফেনী নদীর ওপর চার লেন বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক মানের একটি সেতু নির্মাণ করেছে। রামগড় পৌরসভার মহামুনি ও সাবরুমের আনন্দপাড়া এলাকায় এর অবস্থান। নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ১১০ কোটি রুপী। ৪১২ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১৪ দশমিক আট মিটার প্রস্থ সংযোগ সেতুটি। তবে মূল সেতুটির দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার। বাংলাদেশ ও ভারত সরকার ইতিমধ্যে বন্দর টার্মিনাল, গুদামঘর সহ অন্যান্য অবকাঠামো নিমার্ণে ভূমি অধিগ্রহণ চুড়ান্ত করেছে।
রামগড় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বিশ্ব প্রদীপ কুমার কারবারি বলেন, অনেক বাধা বিপত্তি পেরিয়ে রামগড়-সাবরুম স্থল বন্দর অবশেষে আলোর মুখ দেখছে অবশ্যই তা একটি ইতিবাচক খবর। একসময় ধরে নেওয়া হয়েছিল এটা বোধহয় হচ্ছে না। কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষের আগ্রহ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতায় সফলতার দিকে এগুচ্ছে স্থল বন্দরের অগ্রযাত্রা। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথম স্থাপিত এই বন্দরের বিশাল কর্মযজ্ঞ দরিদ্র মানুষের মুক্তির নতুন দিগন্ত উম্মোচন করবে। এ বন্দর দুদেশের মানুষের জন্যই হবে আশীর্বাদ স্বরূপ। এই বিশ্বায়নের যুগে কোন দেশ কিংবা একই দেশের সব অঞ্চল কোন বিশেষ পণ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ না-ও হতে পারে। প্রাকৃতিক ও বৈষয়িক সুবিধা, উৎপাদনে বিশেষজ্ঞতা ও শ্রম বিভাগের কারণে উৎপাদিত পণ্য পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে আদান-প্রদানের বিষয়টি স্বাভাবিক নিয়মেই হয়।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সহজ যোগাযোগ স্থাপনে ফেনী নদীর ওপর সেতু নির্মাণে ভারত দীর্ঘদিন ধরেই সচেষ্ট ছিল। এটা সম্ভব হওয়ায় ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো ( সেভেন সিস্টার্স) চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি আনতে পারবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা রামগড় স্থল বন্দরের অগ্রগতি বিষয়ে খোঁজ খবর রাখছেন, পরিদর্শনও করেছেন অনেকে। খাগড়াছড়ির ব্যবসায়ী সুদর্শন দত্ত বলেন,বন্দর চালু হলে ব্যবসা-বানিজ্যসহ সব ক্ষেত্রেই অভাবনীয় উন্নয়ন ঘটবে, পুরো এলাকার চেহারাটাই পাল্টে যাবে।
স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মো.আলমগীর (অতিরিক্ত সচিব) বলেন, ‘দেশের ২৪তম স্থলবন্দর রামগড়ের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের সংযোগ সড়ক (রামগড়-বারৈয়ারহাট পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার) উন্নয়ন কাজ বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে জাপানি উন্নয়ন সংস্থা জাইকা কর্তৃক চলমান। সম্ভাব্য খরচ ৩ হাজার কোটি টাকা এবং এটি চার লেনে উন্নিত হচ্ছে।’ পাশাপাশি চট্টগ্রামের নাজিরহাট থেকে রামগড় স্থলবন্দর পর্যন্ত রেল লাইন সম্প্রসারণের মহাপরিকল্পনাটি সংশ্লিষ্ট বিভাগ গুরুত্বের সঙ্গেই দেখছেন। অন্যদিকে ত্রিপুরার আগরতলা থেকে সাবরুম পর্যন্ত রেল লাইনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সাবরুম-উদয়পুর-আগরতলা সড়কগুলো এ মহকুমার সঙ্গে অন্য মহকুমা ও জেলার সড়ক উন্নয়নের কাজও শেষ। সড়ক পথে রামগড়-চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব ৭২ কিলোমিটার এবং সাবরুম-আগরতলা ১৩৩ কিলোমিটার।
সর্বোপরি রামগড় স্থল বন্দর পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হলে বিশ্বায়নের এই যুগে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অবদানের পাশাপাশি বিপুল জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে সূচিত হবে নতুন দিগন্তের। আঞ্চলিক গন্ডি ছাপিয়ে এ যেন বিশ্বব্যাপি সেতুবন্ধনের পূর্বাভাস।