যুদ্ধাপরাধী হিসেবে ফাঁসি হওয়ার মীর কাশেম আলীর প্রতিষ্ঠিত রাবেতা মডেল কলেজ এর নাম পরিবর্তন করে লংগদু মডেল কলেজ করা হয়েছে।
রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার আমতলির জামায়াতে ইসলামি নিয়ন্ত্রিত ‘ইসলামি সেন্টার উচ্চ বিদ্যালয়’র এর নাম পরিবর্তনের দুই বছরের মধ্যেই এবার বদলে গেলে প্রতিবেশি লংগদু উপজেলায় ১৯৯৫ সালের ১ নভেম্বর যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলী প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘রাবেতা মডেল কলেজ’র নাম।
১ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে কলেজটির নাম পরিবর্তিত হয়ে ‘লংগদু মডেল কলেজ’ হিসেবে যাত্রা শুরু করেছে। প্রতিষ্ঠার দুই যুগ পর এই উপজেলার একমাত্র কলেজটির এই নাম পরিবর্তন নিয়ে আছে মিশ্র প্রতিক্রিয়াও। কলেজ কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতারা বলছেন, কলেজে ¯œাতক চালু,উন্নয়ন কার্যক্রম অব্যাহত রাখাসহ কলেজটিকে আরো বেশি সরকারি সহায়তা নিয়ে শিক্ষার্থীবান্ধব করার চেষ্টার অংশ হিসেবেই নাম পরিবর্তিত হচ্ছে এর।
কলেজটির ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আশির দশকে সৌদি আরবের দাতব্য সংস্থা রাবেতা আল আলমে ইসলামীর আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্গম লংগদুতে স্থাপন করা হয় রাবেতা হাসপাতাল। সুবিশাল জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এই হাসপাতাল এবং সংলগ্ন এলাকা ঘিরে তৈরি হয় জামাতে ইসলামির শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামো,যা পার্বত্য এই রাঙামাটি জেলার বাঙালি অধ্যুষিত এই উপজেলায় ধর্মভিত্তিক এই দলটিকে বেশ শক্তপোক্ত অবস্থানে নিয়ে যায়। তারই প্রমাণ মিলে উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যান পদে দলটির উপজেলা আমিরের নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। এই উপজেলার অসংখ্য শিক্ষার্থী দলটির সাংগঠনিক কার্যক্রমের দায়িত্বশীল পর্যায়েও পৌঁছেছে। শুরুতে হাসপাতাল করলেও ধীরে ধীরে এই স্থানে গেস্ট হাউজ,মডেল কিন্ডারগার্টেন,হাই স্কুল এবং কলেজ স্থাপন করেন মীর কাশেম আলী। ১৯৮৯ সালে রাবেতা মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয় ও রাবেতা মডেল উ”” বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ১৯৯৫ সালে যাত্রা শুরু করে রাবেতা মডেল কলেজ। জনবর্ধিঞ্চু এই উপজেলার একমাত্র উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হওয়ায় উপজেলায় উচ্চ শিক্ষা প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে প্রতিষ্ঠানটি। শুধু তাই নয়, স্বাধীনতার পঁয়তাল্লিশ বছরেও এই উপজেলায় প্রতিষ্ঠিত হয়নি কোন সরকারি কিংবা বেসরকারি কলেজ। রাবেতা কলেজটিই ছিলো একমাত্র উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বছর দুয়েক আগে একই উপজেলার গুলশাখালি এলাকায় বিজিবির উদ্যোগে একটি কলেজ এবং সম্প্রতি লংগদু সদরে আরেকটি কলেজের কার্যক্রম শুরু করার আগ অবধি রাবেতা মডেল কলেজই ছিলো এই উপজেলার একমাত্র উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার পর দৃশ্যত বেকায়দায় পড়ে প্রতিষ্ঠানগুলো। সরকারি সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং সরকারি দলের স্থানীয় নেতাদের ক্রমাগত চাপে একসময় সম্পূর্ণই জামাত নিয়ন্ত্রিত এই প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পরিষদসহ বিভিন্নস্তরে সরকারি দলের উপজেলা সভাপতি,সম্পাদকসহ দায়িত্বশীল নেতাদের সম্পৃক্ত করা হয়।
সর্বশেষ কলেজটির নাম পরিবর্তন করে একে লংগদু মডেল কলেজ হিসেবে কার্যক্রম শুরু করায় দৃশ্যত: যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত মীরকাশেম আলীর স্মৃতির সাথে সম্পৃক্তিতাই ছিন্ন করলো প্রতিষ্ঠানটি।
তবে রবিবারও লংগদু উপজেলার সরকারি ওয়েবপোর্টালে কলেজটির সেকশনে গিয়ে দেখা যায়, এখনো কলেজটির গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান হিসেবে মীর কাশেম আলীর নামই দেয়া আছে,সংক্ষেপে এমকে আলী নামে ! কিন্তু কলেজ অধ্যক্ষ জানিয়েছেন, সেখানে হয়তো ভুলেই নামটি রয়ে গেছে,তিনি এখন আর নেই। এখন কলেজের কার্যক্রম তদারকি করছে নতুন কমিটি।
কলেজটির অধ্যক্ষ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘ লংগদু উপজেলাবাসি,স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং সামরিক বেসামরিক প্রশাসনের পরামর্শে আমরা কলেজের নাম পরিবর্তন করেছি। এখন এটি সবার কলেজ হিসেবেই সরকারের প্রতিটি উপজেলায় একটি কলেজকে সরকারি করার কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হয়ে এই উপজেলার মানুষের মঙ্গলে বিগত সময়ের ন্যায় ভূমিকা রাখবে।’ তিনি বলেন, পূর্বতন নাম ও প্রতিষ্ঠানটি সাথে যারা সম্পৃক্ত ছিলেন তারা আর নেই,নতুন করে পরিচালনা পরিষদসহ সবকিছুই করা হয়েছে। উপজেলাবাসির স্বার্থে,সব বিতর্কের অবসান ঘটেছে এবং লংগদু উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল বারেক সরকারই এখন কলেজটির সামগ্রিক কার্যক্রম দেখভাল করছেন। আর কলেজটি সরকারি হলে তো সবকিছুই সরকারের অধীনে পরিচালিত হবে।’
লংগদু উপজেলার নির্বাহী অফিসার প্রবীর কুমার রায় বলেছেন, কলেজটি যারা পরিচালনা করছিলেন,তারাই নাম পরিবর্তন করেছেন। এই বিষয়ে আমাদের কিছু বলার নেই।
রাঙামাটি শহর থেকে নৌপথে প্রায় ৭৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত লংগদু উপজেলা সদর ও মাইনীমুখ ইউনিয়নের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত এই কলেজটিতে বর্তমানে ২১ জন শিক্ষক কর্মচারি ও প্রায় আটশ শিক্ষার্থী আছে। চারটি পৃথক ভবনে কার্যক্রম পরিচালনা করা কলেজটি এতোদিন শুধুমাত্র উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণী কার্যক্রম পরিচালনা করলেও শীঘ্রই ¯œাতক পর্যায়ের শিক্ষা কার্যক্রম চালু হবে বলেও জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
রাবেতা কলেজের নাম পরিবর্তনের এই উদ্যোগের আগে ২০১৬ সালে নাম পরিবর্তন করা হয় জামাত নিয়ন্ত্রিত আরেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইসলামি সেন্টার উচ্চ বিদ্যালয়ের। পাবখালির গহীন অরণ্যে বসবাসকারি বাঙালীদের জন্য প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটির নাম পরিবর্তন করে স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতাদের উদ্যোগে ‘আমতলি উচ্চ বিদ্যালয়’ নামকরণ করা হয়।
নতুন রূপে যাত্রা শুরু
এদিকে সোমবার রাবেতা মডেল কলেজ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে লংগদু মডেল কলেজ হিসেবে যাত্রা শুরু করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির উদ্বোধন করেছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের ২৪ পদাতিক ডিভিশন এবং চট্টগ্রাম এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল এস,এম মতিউর রহমান, এএফডব্লিউসি, পিএসসি।
এসময়খাগড়াছড়ি রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হামিদুল হল, রাঙামাটি ডিজিএফআই কমান্ডার কর্ণেল শামসুল আলম পিএসসি, লংগদু জোন কমান্ডার লেঃ কর্ণেল এম,এম শফিকুর রহমান, লংগদু উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মোঃ তোফাজ্জল হোসেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রবীর কুমার রায়, বাইট্টাপাড়া এক আনসার ব্যাটালিয়ন কমান্ডার মোঃ আবু বক্কর ছিদ্দিক, রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদ সদস্য মোঃ জানে আলম, উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি আব্দুল বারেক সরকার, কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ ছাড়াও সেনা কর্মকর্তা ও এলাকার গন্যমান্য ব্যাক্তিগন, কলেজের শিক্ষক ও ছাত্র ছাত্রীরা এসময় উপস্থিত ছিলেন।