গত কয়েক দিন হলো আকবর সাহেব স্বপরিবারে রাংগামাটি শহর ছেড়ে একেবারে চলে গেলেন। আজ সকালে বাসা থেকে বের হয়ে খালি বাসাটির সামনে দিয়ে যেতেই বার বার মন ফিরে যাচ্ছিল স্মৃতি র পাতায়।
গত শতাব্দীর আশি দশকের শেষ দিকে চাকরীর সুবাদে স্ত্রী কে নিয়ে রাংগামাটিতে তবলছড়ির সরকারী এই বাসাতে উঠেন তিনি। প্রায় তিন যুগ এই বাসায় কাটিয়ে অবসর জীবনে এসে এই শহর থেকে ফিরে গেলেন।
সম্ভবত ১৯৯৫ সাল। দিনটা ছিল বর্ষা মৌসুমের, সকাল সকাল হঠাৎ আকবর সাহেবের ব্যস্ততা বেড়ে গিয়েছিল বাসা থেকে দ্রুত বের হয়ে যান। কিছুক্ষন পর বেবী টেক্সীতে শহরের নামকরা ধাত্রী সহ ফিরে এলেন, আরো বেশ কিছু সময় পর ধাত্রী সহ স্ত্রীকে নিয়ে আবারো বেরিয়ে গেলেন সাথে ৫/৬ বছরের কন্যা রুমা আর আড়াই বছরের শিশু পুত্র রুমেল।
আশেপাশে প্রতিবেশীদের সাথে তেমন একটা আসা যাওয়া না থাকায় কিছুই জানলো না কেউ, কি হয়েছে তাদের?
আকবর সাহেবের অটো পুরাতন বাস স্ট্যান্ড পৌছতেই ধাত্রী নেমে সটকে পড়লেন, স্ত্রী কে নিয়ে তিনি তৎকালীন মাতৃমঙ্গলে গেলে উনারা সদর হাসপাতালে নিতে বলেন সদর হাসপাতালও ভর্তি না করে চট্টগ্রাম রেফার করে দেয়।
তখনকার পরিস্থিতি এমন ছিল না যে, চাইলেই এম্বুলেন্স পাওয়া যায়, অগত্যা কারো পরামর্শে অটোতেই চট্টগ্রাম এর উদ্দেশ্যে রওনা করেন দুই শিশু বাচ্চাকে সাথে নিয়ে।
এদিকে প্রসব যন্ত্রনায় কাতর স্ত্রী আর্তনাদ করে বলছিলেন ওই ধাত্রী সম্ভবত পুশ করার ইঞ্জেকশন ভেংগে মুখে খাইয়ে দিয়েছিলেন বুঝি, আর সেই থেকে গলা বুক আর পেট জ্বলেপুড়ে যাচ্ছিল।
তীব্র যন্ত্রনায় ছটপট করতে থাকা মায়ের অবস্থা দেখে ছোট্ট দুই শিশুও আর্তনাদ করছিল।
প্রচন্ড মনোবল নিয়ে আকবর সাহেব একা সব সামলানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন, অথচ পাহাড়ি আঁকাবাঁকা উচুনীচু পথ যেন ফুরোচ্ছেই না।
সময়ের সাথে ধীরে ধীরে তার স্ত্রী যেন নিতর হয়ে পড়ছে।
একসময় হাসপাতালে পৌছতেই দ্রুত ইমারজেন্সী হয়ে ওটিতে নিতে নিতেই চোখের সামনে তার স্ত্রী শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ গর্ভের নবজাতক কে বাচানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।
নবজাতক আর স্ত্রী হারিয়ে তিনি দিশেহারা হয়ে পড়েন, এদিকে দুই অবুঝ সন্তানের আহাজারিতে পরিবেশটা ভারী হয়ে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়, উনি না পারছেন লাশ নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে, না পারছেন সন্তানদের সামলাতে। এ অবস্থায় অন্যান্য রোগীর স্বজনরা এগিয়ে এলেন তার সাহায্যে, কেউ একজন অটো ভাড়া করে নিয়ে এলেন, এক বয়স্ক মহিলা বাচ্চাদের সামলানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন, কঠিন দুরবস্থা দেখে নিজের রোগী কে অন্যের জিম্মায় রেখে তিনি সাথেও এলেন বাসা পর্যন্ত। এরই মাঝে হাসপাতালের ফোন থেকে নিজ অফিসে ব্যাপারটা জানালে তবেই প্রতিবেশীরা জানতে পারেন দু:সংবাদ টা।
লাশ নিয়ে ফিরে এলে প্রতিবেশীরা আর অফিস ষ্টাফদের সহায়তায় দ্রুতই গোসল কাফন আর জানাজা শেষ করে অফিসের সরকারী গাড়িতেই গ্রামের বাড়ীর উদ্দেশ্যে “নওগা” রওনা করেন,
এ যাত্রায় কয়েকজন তার সাথেও যায়।
দাফন সম্পন্ন করে বাকীরা ফিরে এলেও দুই শিশু সহ আকবর সাহেবের ফিরতে দেরী হবে সবাই তা জানে, আর অফিস কর্তৃপক্ষও বাচ্চাগুলোর কথা ভেবে ওদের কোথাও সেট না হওয়া পর্যন্ত মানবিক কারনে তাকে ছুটি দেয়ার কথাই বলে দিয়েছিলেন।
অথচ কিছুদিনের মধ্যেই হঠাৎ তিনি ফিরে এলেন সাথে এক মহিলা সহ।
জানা গেল গ্রামেই আত্মীয়-স্বজন মাত্র চার মাসের সংসার হারানো আয়েশাকে দুই অবুঝ শিশুর দায়ীত্ব তুলে দিয়ে নতুন সংসার গড়ে দেন আকবর সাহেবের সাথে।
প্রতিবেশী মহিলারা যেন পালা করে আয়েশাকে দেখতে আসছিল আর সে ও তাদের যথাসাধ্য মেহমানদারী করে যাচ্ছে।
সতর্ক নজরে আসলে সবাই পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করছিলো, সৎ মা হিসেবে অসৎ আচরনের মহড়া টা র দর্শক হতেই এসেছিল সবাই।
ত্রুটি অনুসন্ধান কারীদের কেউ কেউ খেয়াল করেন তাদের ধারনার উল্টোটাই ঘটছে।
বাচ্চাগুলো আয়েশার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করছে অথচ নির্বিকার ভাবে সে তাদের বিশ্বাস অর্জনের চেষ্টা করছে, বাচ্চাদের ধারনা সে কাজের মহিলা।
আয়েশাকে ওরা তাদের মায়ের খাটে, এমনকি কোন চেয়ারেও বসতে দেয় না, বাবার সাথে ওরা ডাইনিং টেবিলে খেতে বসলে আয়েশা নীচে মেঝেতে বসে খায়। রাতে ওরা বাবার সাথে খাটে শোয় আর আয়শা মেঝেতেই বিছানা পাতে, এভাবে চলছে দিনের পর দিন। আয়েশা পরম ধৈর্য্য সহকারে সবই সহ্য করছিলো।
সকালে আকবর সাহেব অফিসে গেলে দিনের দীর্ঘ সময় ধরে সে বাচ্চাদের মন পাওয়ার চেষ্টা করে সমস্ত বায়না আবদার রক্ষা করে চলে, আর বোঝাতে চেষ্টা করে আল্লাহ তোমাদের জন্য আমাকে তোমাদের মা করে পাঠিয়েছে।
না কোনভাবেই বরফ গলে না, তাদের মায়ের জায়গা কাউকেই দিবে না তারা।
ছয় মাসের বেশী এভাবেই কেটে গেলো আয়েশা ধৈর্য্য হারায়নি একটুও।
নতুন বছরের শুরুতে রুমাকে সেন্ট ট্রিজার স্কুলে ভর্তি করা হলো, এবার কাকডাকা ভোরে উঠে গৃহস্থলী কাজ শেষ করে রুমেল কে সাথে নিয়ে স্কুলে যাওয়া আর ছুটি হলে ফিরে আসা নিয়মিত রুটিন হয়ে গেলেও কিছুদিন পর আর বসে থাকার ডিউটি করতে হয় না।
তখন বাবাই রুমাকে দিয়ে আসে আর ছুটির পর আয়শা রুমেল কে নিয়ে তাকে আনতে যায়।
ধীরে ধীরে বাচ্চাগুলোও যেন বশ মানতে শুরু করেছে।
মাঝে মাঝে এক আধটু মা ডাকা শুরু করেছে রুমেল।
একদিন সকালে ওদের তিন জনকে নাস্তা দিয়ে আয়েশা থালায় পান্তা ভাত আর কাচা মরিচ নিয়ে টেবিলে বসতেই রুমেলের আক্রমন, চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে থালা সহ খাবার মেঝেতে ফেলে দিলে প্লেট ভেঙ্গে সারা ঘরে পান্তাভাত ছড়িয়ে পড়ে। আচমকা তার এ কান্ডে সবাই হতচকিত তাকাতেই রুমেল আয়েশার গলা জড়িয়ে হাউমাউ কেঁদে বলতে থাকে তোমাকে না আল্লাহ পাঠিয়েছে মা করে, সকালে পান্তা ভাত দিয়ে কাচা মরিচ খেলে ঐ দিন তো মা মরে যায়, তুমি আজকে মরে গেলে আল্লাহ যদি আর মা না দেয়?
ছেলের এ কথায় সম্বিত ফিরে আসে আকবর সাহেবের, বুকের ভেতর দুমরে-মুচরে চোখের সামনে ভেসে উঠে সেই ভয়ংকর সকালের কথা যেদিন তার স্ত্রী না ফেরার দেশে চলে গেলেন সেদিন সকালে শেষ বারের মত ও কাঁচামরিচ দিয়ে পান্তা ভাত খেয়েছিল।
আয়েশা জানে, একজনের খালি একটা আসনেই বসেছে সে, যে আর কখনোই সে আসনটি ফিরে চাইতে আসবে না।
আর তাই সংসার টা কে বুকে আগলে রেখে শান্তির নীড় গড়ে তোলার চেষ্টায় সফল হয়ে উঠে নিজ যোগ্যতায়।
বাচ্চা গুলোও ধীরে ধীরে তাদের মায়ের কথা ভুলতে লাগলো অথচ প্রতি বছর ঐ দিনটাতে বিশেষ দোয়ার ব্যবস্থা আয়েশা নিজেই করতো। প্রতিবেশীদের সাথেও সু-সম্পর্ক ছিল তার।
বিয়ের ঠিক পাঁচবছরের মাথায় আয়েশার কোল জুড়ে রুবেল এর জন্ম হয়, না রুমা আর রুমেলের প্রতি মায়া তখনও এতটুকু কমেনি তার বরং মনে হচ্ছিল দায়ীত্ববোধ টা আরো দ্বিগুন বেড়ে গিয়েছিল।
২০০৭ সালের রোজার ঈদের আগের দিন সন্ধ্যার ঘটনা, পাশের বাসার মহিলা তার ঘরে এসে দেখেন, পরিবারের সবাই ঈদের বাজার নিয়ে বসেছে, সব খুলে দেখাচ্ছিল আয়েশা।
আকবর সাহেব সচরাচর ঈদের বাজেট আয়েশার হাতেই তুলে দেন এবারও ১০০০০/- দিয়েছিলেন, অথচ রুমার জন্যেই ৬০০০/- টাকার মার্কেটিং।
রুমেলের-২০০০/-, রুবেলের শপিং ৯০০/- টাকায় সেরে, ৬০০/-টাকা দিয়ে আকবর সাহেবের জন্য পাঞ্জাবী কিনেন। অথচ নিজের জন্যে কেনা শাড়ীটা বের করছে না, বাচ্চাদের জোরাজুরিতে অবশেষে বের করলে দেখা গেল, মাত্র ৩৫০/ টাকার একটি শাড়ি।
এতেই মহাতৃপ্তিতে ভুবনজয়ী হাসির রেখা ফুটে উঠেছিল মহিলার ঠোটের কোনায়।
ঘটনাটা পাশের বাড়ীর মহিলা নিরবে দেখে যাচ্ছিল, আকবর সাহেব বাচ্চাদের নিয়ে সরে যেতেই মহিলা জিজ্ঞেস করল মেয়েটার জন্যে তিনসেট থ্রি পিস থেকে একটা কমিয়ে নিজের জন্যে তো একটা ভাল কাপড় নিতে পারতেন। আয়েশা আরেকবার বিজয়ির হাসিতে মহিলাকে উত্তর দিলো, মেয়েটা সবে কলেজে ভর্তি হয়েছে ভালো কাপড় চোপর পড়ে বাইরে যাবে সবাই দেখবে, আমি ঘরেই থাকি, দামী সুন্দর আর বেশী কাপড় তো আমার প্রয়োজন নেই।
মহিলা এর আগেও অনেকবার আয়েশার বিশাল মনের পরিচয় পেয়েছিল তবে আজ পরম শ্রদ্ধ্যায় নিরবে অশ্রুজল গড়িয়েছে, ত্যাগের আনন্দে বিজয়ের এক নতুন শিক্ষা অর্জন করলো তার কাছে।
এই শহরেই মেয়ে রুমাকে অনার্স মাষ্টার্স কমপ্লিট করিয়েছেন।
ঢাকা শহরে প্রাইভেট কোম্পানিতে ভালো চাকরি করা উচ্চশিক্ষিত পাত্র দেখে ভালো পরিবারে গত কয়েকবছর আগে রুমাকে বিয়ে দিয়েছেন, ভালোই আছে মেয়েটা।
ছেলে রুমেল কৃষি ডিপ্লোমা শেষ করে বর্তমানে চাকরি করছে আর রুবেল এখন অনার্স পড়ছে।
আয়েশার আচরনে একসময় হয়ত রুমা আর রুমেল খুব ছোট কালের সেই স্মৃতিটা ভুলেই গেছে।
আকবর সাহেব মোটামুটি সুস্থ্য হলেও ইদানিং প্রায়ই আয়েশা অসুস্থতা বোধ করেন শুনেছিলাম।
বিক্ষিপ্ত ভাবে মনে আসা স্মৃতির কারনে আজ কয়েকটা প্রশ্ন আমার মনে উঁকি দিচ্ছে।
আয়েশা সঠিক মুল্যায়ন পাবে কি আগামিতে?
রুমা, রুমেল আর রুবেল আয়েশার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হবে না তো?
আমৃত্যু এ বন্ধনে কাটবে তো তাদের?
সমাজ তাদের ঐক্য বিনষ্ট করে দেবে না তো?
লেখক : আহমেদ ফজলুর রশীদ সেলিম, ক্রীড়া সংগঠক ও সাবেক ছাত্রনেতা