সুহৃদ সুপান্থ
বড় দলে নেতা কিংবা কর্মী,কোনটারই অভাব থাকেনা কোন কালেই। কিন্তু রাজনীতির ‘সুসময়’ কিংবা ‘দু:সময়’, দুধের মাছি নাকি পরীক্ষিত কর্মী, এই বিতর্কতো সেই সুপ্রাচীনকালেরই। বড় কোন দল যখন দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকে,তার কর্মীর অভাব হয়না। ঝাঁকে ঝাঁকে নেতা কর্মী সমর্থকে থৈ থৈ করে দলীয় কর্মসূচী ও দলের কার্যালয়। সেই ‘সুখের সময়’-এও ঠিক কিছু মানুষ ‘অবাক মৌনতা’য় ভাবে পেছনে ফেলে আসা দিন,তিল তিল করে গড়ে তোলা সংগঠন,কর্মীহীনতার কঠিন সময় আর ভোটের ময়দানে বারবার মন খারাপ করে ঘরে ফেরার দিনগুলো ! বাবুল দাশ বাবু,সেই বিরল প্রজাতিরই একজন হয়ত ! লংগদুর মতো কঠোর কঠিন এবং বৈরি এক জনপদে নৌকায় যে উপচে পড়া যাত্রী,এমন সুখের দিন সবসময়ই ছিলোনা ! ভোটে জেতা তো দূর অস্ত,এমনকি লংগদুতে দলীয় কর্মসূচী পালন করতে যেতেও ভয় পেতেন জেলার নেতারা। এমন কঠিন সময়ে যারা তৃণমূল থেকে একটু একটু করে করে সংগঠিত করেছেন দলকে তিনি তাদেরই একজন।
জন্ম কিংবা বেড়ে উঠা সবই তার লংগদুতে। তিনটিলা-লংগদু হাই স্কুল হয়ে রাঙামাটি সরকারি কলেজে পড়তে এসে জেলার নেতার খুব কাছাকাছি চলে আসেন বাবু। ছাত্রলীগের পরীক্ষিত এই কর্মী পড়াশুনা শেষে ফিরে গেছেন নিজের জন্মভূমিতেই। সেখানেই ছাত্রলীগ হয়ে আজ আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক। প্রবীন কিছু আওয়ামীলীগারকে সাথে নিয়ে একদা বিএনপির দুর্গ লংগদুকে ভেঙ্গে তছনছ করে নৌকার দুর্গে পরিণত করার ‘মাস্টারমাইন্ড’ এই বাবুই।
উপজেলায় ছাত্রলীগ,যুবলীগ কিংবা অন্য যেকোন সহযোগি সংগঠনের কাছে ‘বাবুদা’ নামেই পরিচিত এই নেতা। অনেকেই দলে এসেছেন,দল ছেড়েছেন,কেউ পেয়েও বদলেছেন আর কেউ কেউ স্বার্থের প্রয়োজনেই উল্টে গেছেন,নীতি কিংবা আদর্শের প্রতি ন্যুনতম শ্রদ্ধা দেখাননি। কিন্তু বাবু যেনো সবার চেয়ে আলাদা। কখনো উপজেলা চেয়ারম্যান হতে চাননি,মনে মনে চেয়েও পাননি জেলা পরিষদ সদস্যের মর্যাদাও,কিন্তু অভিমানে কিংবা কষ্টে বেদনাহত হননি। একদিনও বিরত থাকেননি দলীয় কর্মসূচী থেকে। বুকের বেদনা বুকে চেপেই দলের কঠিন সময়েও কী অদ্ভূত মৌনতায় করে গেছেন সব কর্মসূচী।
সম্প্রতি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে ঘিরে দলের দুই পরীক্ষত প্রবীণ নেতা যখন ‘পারিবারিক স্নেহের’ উপরে উঠতে ব্যর্থ হয়েছেন,হারিয়েছেন দলীয় পদও, সেই কঠিন সময়ে ‘উপেক্ষিত’ কিছু নেতাকে সাথে নিয়ে ফের মাঠে নেমে পড়েন বাবু নৌকার প্রার্থীদের জেতাতে। যেনো সেই পুরনো দিনগুলোই ফিরে এসেছে আবার।
লংগদুতে আওয়ামীলীগের কর্মীদের মধ্যে বরাবরই রয়েছে তিন ধরণের নেতাকর্মী। এদের একদল রক্তে মাংসেই আওয়ামীলীগ,আরেকদল হাজী ফয়েজের নেতৃত্বে যোগদানকৃত আওয়ামীলীগ আর আরেকটা অংশ আছে,যারা সারাদেশের মতো নব্য আওয়ামীলীগার। এই তিন ধরণের আওয়ামীলীগারদের নিয়েই লংগদু আওয়ামীলীগের ‘অসুখী সংসার’। এই অসুখী সংসারকে শত প্রতিকূলতায়ও আগলে রেখেছেন যিনি,তিনিই বাবুল দাশ বাবু। দীপংকর তালুকদার কিংবা জেলা আওয়ামীলীগের আস্থা ও বিশ্বাসের অন্য এক নাম।
বাবুল দাশ বাবু বলছেন-‘ আমিতো আওয়ামীলীগ করি। দল আমাকে কি দিলো কিংবা দিলোনা,সেইসব নিয়ে কখনই ভাবিনি। দলীয় সিদ্ধান্ত,দলের প্রতীক এবং প্রার্থীই আমার কাছে সবচে গুরুত্বপূর্ণ। দল তো একটাই করেছি জীবনে,দলের জন্য জীবন দিতেও পিছপা হবনা। সবসময়ই চেষ্টা করেছি,দলের প্রতি কমিটেড থাকতে,আমৃত্যু তাই’ই থাকব।’
রাঙামাটির রাজনীতিতে এখন সবচে গুরুত্বপূর্ণ জেলা ধরা হয় লংগদু উপজেলাকে। এই উপজেলার ভূমিধ্বস ভোটেই ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন দীপংকর তালুকদার,যাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো বারেক সরকার,আব্দুর রহিম,হাজী ফয়েজসহ আওয়ামীলীগের সব নেতাকর্মীদেরই। তবে প্রকৃত সত্য হচ্ছে,এই ভূমিকার পেছনের মূল রূপকারই ছিলেন আদতে বাবুল দাশ বাবু,দ্য সাইলেন্ট জিনিয়াস অব লংগদু পলিটিক্স !
এবারের ইউপি নির্বাচনেও যখন সন্তান আর ভাতিজার মোহকে উপেক্ষা করতে ব্যর্থ বারেক-রহিম চুপচাপ,সেই কঠিন সময়েও তরুণ ও নারী কর্মীদের নিয়ে মাঠে ঘাটে ছুটে বেড়িয়েছেন বাবু। জেলা আওয়ামীলীগও পুরো আস্থাই রেখেছে তার উপরই। শুধু জেলা আওয়ামীলীগই নয়,উপজেলা তৃণমূল কর্মীদেরও ভরসার অন্য নাম ‘বাবুদা’।
আগামী ৭ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীরা আদৌ জিতবে কিনা,কিংবা দলীয় ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করতে পারবে কিনা,নেপথ্যে নানা নাটক করে বিদ্রোহীদের কিংবা বিপক্ষ দলের প্রার্থীদের জিতিয়ে দেয় কিনা,এসবই বিতর্ক ও প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয় হয়ত। হয়ত কোথাও জিতবে কিংবা কোথাও হারবে নৌকার প্রার্থীরা। কেউ হয়ত জিতে বদলে যাবে,কেউবা পরাজয়ের দায় চাপিয়ে নিষ্ক্রিয় হবে দল থেকে,কিন্তু যাবতীয় উত্থান পতন কিংবা নাটকীয়তায়ও ঠিক নি:সঙ্গ শেরপার মতো বৈরি এক জনপদে নৌকার সর্বশেষ মাঝি হিসেবেও অন্তত বেঁচে থাকবে একজন,বাবুল দাশ বাবু যার নাম,সকলের প্রিয় ‘বাবুদা’ হিসেবেই সমধিক পরিচিত যিনি। দুর এক সবুজ পাহাড়ে নৌকার লগি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা এক নি:সঙ্গ শেরপা ! রাজনীতি তাকে খুব বেশি হয়ত কিছু দেয়নি,কিন্তু যা দিয়েছে তাইবা কম কি !