পার্বত্য অঞ্চলে এক দশকে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হলেও চ্যালেঞ্জ রয়েছে ৩ পার্বত্য জেলাকে ঘিরেই। দেশে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের ৯১ ভাগের বসবাস রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে। যোগাযোগ সমস্যার কারণে পাহাড়ি ও সীমান্তবর্তী এলাকায় চিকিৎসাসেবা পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না বলে এমন প্রাদুর্ভাব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাই পার্বত্য ৩ জেলার ২৩টি উপজেলাকে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে ম্যালেরিয়া স্ক্রিনিং ও ওষুধ সরবরাহ করার কথা জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে এই ৩ জেলা বাদে দেশের ১৪টি জেলায় এ কার্যক্রম চলছে।
এক সময় ম্যালেরিয়া হয়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়ায় দুষ্কর ছিল পার্বত্য জেলাগুলোতে। অথচ গেল কয়েক বছরে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়নি একজনেরও। ২০১৬ সালেও যেখানে মৃত্যু হয় ১৭ জনের। মশারি ওষুধসহ সরকারি বেসরকারিভাবে নেয়া অব্যাহত কর্মসূচির ফলে ম্যালেরিয়া ভীতি নেই রাঙামাটিবাসীর। সমতল ভূমিতে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ সহজ হলেও পার্বত্য অঞ্চলে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে সরকার।
সরকারি তথ্যমতে, দেশে মোট ম্যালেরিয়া আক্রান্তের ৯১ ভাগ পার্বত্য তিন জেলায়। এসব দুর্গম এলাকায় নজরদারি কমিটির পৌঁছতে না পারা, সাধারণ মানুষের মধ্যে অসচেতনতা ও জাতীয় কর্মসূচির সাথে স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করতে না পারায় নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না ম্যালেরিয়া। স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য মতে, বছবে দু ধাপে ৬ মাস ম্যালেরিয়া হবার ঝুঁকি বেশি থাকে, ধাপগুলো হচ্ছে মে থেকে জুলাই এবং অক্টবরর থেকে ডিসেম্বর। আগামী ৩০ সালের মধ্যে ম্যালেরিয়া নির্মূলের সরকারি পরিকল্পনা সফল করতে ঝুঁকিসমূহ নির্ণয় করে কাজ শুর করেছে সরকার।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যালেরিয়া প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডাক্তার এম এম আক্তারুজ্জামান বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার বাংলাদেশ থেকে ম্যারেরিয়া নির্মূল করার চ্যালেঞ্জ নেয়া হয়েছে, সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি আমরা। কিন্তু দেশের মোট ম্যালেরিয়া আক্রান্তের প্রায় ৯০ ভাগ আক্রান্ত হয় ৩ পার্বত্য জেলায়। তাই আমাতের কর্মপারিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে সেভাবেই, যেখানে আক্রান্তর সংখ্যা বেশি সেখানেই সর্বোচ্চ প্রতিষেধক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আমাদের পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করা হলে যে সকল সহযোগিতাগুলো লাগবে তা হলো, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, রাজনৈতিক সদিচ্ছার কোন বিকল্প নেই। দ্বিতীয়ত হলো যোগাযোগ ব্যবস্থা, কারণ আপনারা জানের পার্বত্য অঞ্চলে দুর্গমতা হলো প্রধান বাধা, এমন অনেক এলাকা আছে যেখান থেকে একদম নিকটবর্তী স্বাস্থ্য ক্লিনিকে হেঁটে আসতেও কয়েক ঘন্টা সময় লাগে। এসব এলাকার ম্যালেরিয়া, পাশাপাশি বর্ডার জোন মানে ভারত মিয়ানমারের যে সীমান্ত এলাকা যে ম্যালেরিয়া রয়েছে তা চিহ্নিত করা জরুরি। আমরা জানি আমাদের দেশের সাথে ভারতের ৫টি অঙ্গ রাজ্য ও মিয়ানমারের একটি অংশ সংযুক্ত আছে, যার মধ্যে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য ও মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব মারাত্মক, এদের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমানা রয়েছে। তাই আমাদের যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে এবং ক্রস বর্ডার সমন্বয় করতে পারি, এবং দুর্গম এলাকার জন্য বিশেষ প্যাকেজ নিয়ে সকল সুবিধা ভোগীদের নিয়ে কাজ করতে পারি তাহলে সহজেই লক্ষ্যমাত্র অর্জন করতে পারবো।
অপরদিকে লক্ষ্য করা যাচ্ছে আমাদের দেশের মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বেড়েছে। ফলে প্রচুর মানুষ প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে থেকে রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির প্রত্যন্ত এলাকায় পর্যটক হিসাবে বেড়াতে আসেন, তারা হয়তো নিজের অজান্তেই শরীরে নিয়ে যাচ্ছেন ম্যারেরিয়া জীবাণু, তারা অসুস্থ হলে ডাক্তারকে তার ভ্রমণ ইতিহাস বলেন না, রোগ নির্ণয়ে সম্ভব হয় না। যার ফলে সমতলের জেলাতেও এ রোগ ছড়িয়ে পড়ার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে আক্তারুজ্জামান বলেন, ম্যালেরিয়া নির্মূলে এটাও আমাদের একটা চ্যালেঞ্জ, এ ব্যাপারে আমারা সমতলের চিকিৎসকদের পরামর্শ দেই চিকিৎসা সেবা দেয়ার পূর্বে যাতে রোগীর ভ্রমণ ইতিহাস জেনে নিয়ে সে মোতাবেক চিকিৎসা প্রদান করেন।
তিনি আরও বলেন, পাহাড়ের মানুষও সব সময় সুরক্ষিত থাকতে পারেন না, জীবন ও জীবিকার তাগিদে তারা পাহাড়ে পাহাড়ে বাস করে, তখন তাদের সাথে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধক মশারি থাকে না, ফলে সেখান থেকেও জীবাণু বহন করে লোকালয়ে নিয়ে আসতে পারে, এটাও চিহ্নিত করা এক ধরণের চ্যালেঞ্জ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য মতে, ম্যালেরিয়া নির্মূলে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে রোহিঙ্গা। দেশের কক্সবাজার ছাড়া পার্বত্যাঞ্চলের সীমান্তে বর্তমানে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসাবে বাস করছে, এদের মধ্যে ২৬ জন ম্যালেরিয়া রোগী পাওয়া গেছে। এ প্রসঙ্গে আক্তারুজ্জামান বলেন, আমাদের সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। এদের কারণে মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়তে হতে পারে আমাদের। কারণ আমাদের ম্যালেরিয়া আর ওদের ম্যালেরিয়া জীবাণু এক নয়। আমাদের রোগের সর্বোচ্চ পর্যায় হচ্ছে সেলিব্রেরিয়া ম্যালেরিয়া, কিন্তু ওদেরটা হচ্ছে ভাইভেক্স ম্যালেরিয়া। তারা আমাদের দেশের মানুষের সাথে মিশে যাচ্ছে। সব থেকে ভয়ংকর ব্যাপার হলো ওদের দেশে ম্যালেরিয়া রেজিসটেন্স রয়েছে। ওদের দেশে প্রচলিত ওষুধ দিয়ে ম্যালেরিয়া ভাল হয় না, অর্থাৎ ওষুধের কার্যকরিতা হারিয়েছে। আমরা রোহিঙ্গাদের মধ্যে ২৬ জন ম্যালেরিয়া রোগী পেয়েছি, তাদের বিশেষ ব্যবস্থায় রাখা হয়েছে, তারা ম্যালেরিয়া রিজিসটেন্স কিনা সেটা পরীক্ষা করার জন্য বিআইটিআই সাথে সমঝোতা স্মারক সই করেছি, তারা গবেষণা করে দেখবেন এসব রোগী ম্যালেরিয়া রেজিসটেন্স কিনা। যদি হয় তাহলে আমারা বিরাট ঝুঁকিতে পড়ে যাবো, এবং আমাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নাও হতে পারে।
তবে সব কিছুরই একটা নিয়ম থাকে ফাস্টলাইন সেকেন্ডলাইন, প্রথমতা ফেল করলে আমাদের প্রচুর বেগ পেতে হবে, সেকেন্ড লাইনে যেতে হবে, সেক্ষত্রে নিয়মানুসারে ড্রাগরেগুলেশন, টেকনিক্যাল কমিটিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মিলে নতুন কার্যকরী ওষুধ উৎপাদন করে চিকিৎসা দিতে হবে।
স্বাস্থ্য বিভাগের জরিপে দেখা যায়, রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলার মধ্যে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বান্দরবানে বেশি। তবে বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া রেজিসটেন্স নয়, প্রচলিত ওষুধ এখানে এখনো কার্যকর। মোট কথা এসডিজি অর্জনের লক্ষে সকলকে সাথে নিয়ে মাঠ কাজ করছে সরকার, আগে লক্ষ্য ছিল ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ, এখন কাজ করা হচ্ছে নির্মূলের জন্য। তাই ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক নয়, প্রতিরোধে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহবান প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের।