শংকর হোড় ॥
রাঙামাটির শহরমুখ শিমুলতলীর বাসিন্দা আবু বক্কর সিদ্দিক মিঠু। পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকেন শিমুলতলীতে। গত ১৫ বছর ধরেই এই এলাকায় বাস করছেন তিনি। কিন্তু বর্ষা আসলেই পাহাড়ধসের ঝুঁকিতে থাকতে হয় তাঁকে। দিনের বেলায় বাসায় অবস্থান করলেও রাতে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যেতে হয় পরিবার নিয়ে। শুধু মিঠুর পরিবারই নয়, এভাবে দিন চলে শিমুলতলীর শতাধিক পরিবারের। ২০১৭ সালে পাহাড়ধসে এই শিমুলতলীতেই মারা যায় ২৫ থেকে ৩০জন। এতবড় দুর্ঘটনার পরও কেউ এলাকা ছাড়তে রাজি নয়; বরঞ্চ দিন দিন এই পাহাড়ি টিলায় বেড়েছে বসত।
আবু বক্কর সিদ্দিক মিঠু জানায়, এটাই আমাদের পরিবারের সম্বল। ঝুঁকি জানার পরও থাকতে হচ্ছে। তাই জীবন শঙ্কা নিয়ে হলেও বাস করতে হচ্ছে আমাদের। সরকার যদি অন্য কোথাও আমাদের জন্য স্থায়ীভাবে ব্যবস্থা নিতেন, তাহলে আমরা চলে যেতাম।
এই চিত্র শুধু শিমুলতলীর নয়; পুরো রাঙামাটির সামগ্রিক চিত্র। জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, রাঙামাটি পৌরসভার নয়টি ওয়ার্ডের ৩৩টি এলাকায় সাড়ে তিনশ পরিবার ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, চম্পানির মার টিলা, চেঙ্গির মুখ, এসপি অফিস সংলগ্ন ঢাল, মাতৃমঙ্গল এলাকা, কিনারাম পাড়া, স্বর্ণটিলা, রাজমনি পাড়া, পোস্ট অফিস কলোনি, মুসলিম পাড়া, কিনা মোহন ঘোনা, নতুন পাড়া পাহাড়ের ঢাল, শিমুলতলী, রূপনগর এলাকা পাহাড়ের ঢাল, কাঁঠালতলী মসজিদ কলোনি, চম্পকনগর পাহাড়ের ঢাল, আমানতবাগ স্কুলের ঢাল, জালালাবাদ কলোনি পাহাড়ের ঢাল ও অন্যান্য এলাকা।
এর বাইরে রাঙামাটি সদর উপজেলার ৬টি ইউনিয়নে ৭৫০ পরিবারের ৩ হাজার ৪২৪ জন লোক পাহাড়ের ঢালে ঝুঁকিতে আছে। রাজস্থলী উপজেলায় তিন ইউনিয়নে ২৮৬টি পরিবারের ১ হাজার ১৮২ জন, কাপ্তাই উপজেলার ৫ ইউনিয়নে ৫৮০ পরিবারের ২ হাজার ৭৯৩ জন, বরকল উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নের ৩৭৭ পরিবারের ১ হাজার ৮৫০ জন, জুরাছড়ি উপজেলার ৪ ইউনিয়নে ৬৪ পরিবারের ৩২০ জন, নানিয়ারচর উপজেলার ৪ ইউনিয়নে ২৩৯ পরিবারের ১ হাজার ১১১ জন, লংদুতে ৩ ইউনিয়নের ১০৮ পরিবারের ৫১৪ জন, বিলাইছড়ির ৩ ইউনিয়নের ২৪৫ পরিবারের ১ হাজার ১৭৯ জন, কাউখালী উপজেলার ৪ ইউনিয়নের ১২০ পরিবারের ৫৫৩ জন সহ মোট ১২ হাজার ৯২৬ জন লোক পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে আছে।
এদিকে জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে গত ৫ বছরে পাহাড়ধসে রাঙামাটিতে ১৩১জনের মৃত্যু হয়েছে। গত ২০১৭ সালের ১৩ জুন পাহাড় ধসে ১২০ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে ৭৩ জনই মারা যান রাঙামাটি সদর উপজেলায়। এর বাইরে কাউখালী উপজেলায় ২১ জন, কাপ্তাইয়ে ১৮ জন, জুরাছড়িতে ৬জন ও বিলাইছড়ি উপজেলাতে ২ জন নিহত হন। এতে আহত হয় দুই শতাধিক মানুষ। ব্যাপক ক্ষতি হয় পুরো জেলায়। তিন মাস আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছিল প্রায় তিন হাজার মানুষ। পরের বছর ২০১৮ সালের ১১ জুন আবারো পাহাড়ধসে নানিয়ারচরে প্রাণহানি ঘটে ১১ জনের।
এসময় সারাদেশের সাথে সড়ক যোগাযোগও বন্ধ হয়ে যায় রাঙামাটির। এছাড়া পুরো জেলা জুড়ে প্রকৃতির ভয়াল তান্ডবে তছনছ হয়ে যায় অসংখ্য ঘরবাড়ি। আহত হয়েছে দু’শতাধিকের অধিক মানুষ। এই দুর্যোগে জেলায় ১৮ হাজার ৫৫৮টি পরিবার কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১২৩১টি বাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত এবং নয় হাজার ৫৩৭টি বাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
এদিকে বৃহস্পতিবার রাত থেকেই টানা বর্ষণ শুরু হয়েছে। শুক্রবার সারাদিনও রাঙামাটিতে বৃষ্টি হয়েছে। শনিবারও বিকাল পর্যন্ত বৃষ্টি হচ্ছে। আবহাওয়ার তথ্যমতে, আরো ২-৩দিন বৃষ্টি থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে পাহাড়ের মাটি নরম হয়ে ধসের শঙ্কা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এরমধ্যে রাঙামাটি শহরের ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন এলাকায় সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড টাঙিয়েছে জেলা প্রশাসন। তারপর সচেতনতা কম স্থানীয়দের মাঝে। রাঙ্গাপানি, মোনতলা আদাম এলাকার বাসিন্দা ফনী চাকমা ও জীবন চন্দ্র চাকমা বলেন, বর্ষা মৌসুম আসলে জেলা প্রশাসন থেকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্ন দিয়ে চলে যায়। কিন্তু স্থায়ীভাবে কোনও ব্যবস্থা না নিলেও ঝুঁকিপূর্ণ সচেতনতার চিহ্ন দিয়ে কোনও লাভ হবে না। রূপনগর এলাকার বাসিন্দা খোকন ইসলাম বলেন, বৃষ্টি হলে আমাদেরও ভয় কাজ করে। ২০১৭ সালের কথা বেশি মনে পড়ে। সে রাতের স্মৃতি কখনো ভুলতে পারবো। দিনের বেলায় কাজে থাকলেও রাতে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যাই।
রাঙামাটি পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর রবি মোহন চাকমা বলেন, প্রশাসন থেকে বর্ষা শুরুর আগ থেকেই ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের নিরাপদে সরে আসার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। আমরাও তাদেরকে সচেতন করার চেষ্টা করছি, কিন্তু মানুষের মধ্যে সচেতনতা একটু কম। আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে, কিন্তু মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে চায় না। তারপরও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি যাতে লোকজনদের নিরাপদে নিয়ে আসতে পারি। প্রশাসন থেকে বারবার মাইকিং করা হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, ২০১৭ সালে ব্যাপক পাহাড়ধসের পর পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের নিরাপদে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য প্রশাসনকে জানানো হয়েছে। যতদূর জানতে পেরেছি প্রশাসনও এই বিষয়ে একটা উদ্যোগ গ্রহণ করছে।
জানতে চাইলে এই প্রসঙ্গে রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, পাহাড়ধসে প্রাণহানি এড়াতে আমাদের সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। গতকাল(শুক্রবার) আমি নিজেই রাত দুইটা পর্যন্ত এলাকায় এলাকায় গিয়ে তাদেরকে আশ্রয়কেন্দ্রে আনার ব্যবস্থা করেছি। আজ(শনিবার) বিকাল থেকে চারটা টিম ঝুঁকিতে বসবাসকারীদের আশ্রয়কেন্দ্রে আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। যারা আসতে চাইবে না, তাদেরকে জোর করে হলেও আনা হবে অথবা আইনের প্রয়োগ করা হবে। কোনও অবস্থাতেই আমরা প্রাণহানি হোক এটা চাই না। তাদেরকে সচেতন করতে দিন-রাত মাইকিংয়ের মাধ্যমে প্রচারণা চালানো হচ্ছে।