রক্তের যোগসূত্র নেই তাদের। তবুও রাঙামাটির রাজনীতিতে ‘মামা-ভাগিনা’ হিসেবেই পরিচিত তারা। মামা ছিলেন একজনই,কিন্তু ভাগিনা তিনজন ! একটা সময় মামা-ভাগিনারা পরষ্পর ছিলেন হরিহর আত্মা। কিন্তু ‘যুদ্ধ-প্রেম-রাজনীতি কিংবা খেলা’র শেষ মুহুর্ত্ব পর্যন্ত যেমন কিছুই নিশ্চত নয়,তেমনি তাদের সম্পর্কও এগিয়েছে এমন অনিশ্চয়তায়। মামা সাইফুল ইসলাম ভূট্টো আর তার তিন ভাগিনা জাহিদুল ইসলাম জাহিদ,সাইফুল ইসলাম শাকিল আর আবু সাদাত সায়েম’র রাজনীতি আর সম্পর্কের গল্পটা তাই বেশ চমকপ্রদই।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, এককালের বিনেসুতোয় গাঁথা সেই সম্পর্ক আর নেই, চারজনের পথ আলাদা আলাদা,যে যার নিজস্ব পথেই হাঁটছেন। কিন্তু কি হয়েছিলো তাদের ? জানার চেষ্টা করেছে পাহাড়টোয়েন্টিফোর ডট কম। সেই জানার চেষ্টাতেই বেরিয়ে এসেছে নানা প্রশ্নের উত্তর,সম্পর্কের সাতকাহন,জটিলতা এবং সমীকরণ। মামা আর ভাগিনাদের সাথে কথায় কথায় জানা গেলো বহু পুরনো নতুন কথন।
সাইফুল ইসলাম শাকিল
আমরা আমাদের ‘মামা’ সাইফুল ইসলাম ভূট্টোর উত্তরসূরী ছিলাম,সেভাবেই জানত সবাই। তার সাথে আমাদের ‘সম্পর্কটা রক্তের ছিলোনা হয়ত,কিন্তু আত্মার ছিলো’, এতে দূরত্ব তৈরি করার দায় একান্তই তার নিজের। ওনি মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর যে ক্ষমতাকেন্দ্রিক আত্মকেন্দ্রিক রাজনীতি চর্চা শুরু করেছিলেন,সেটাই তাকে ধীরে ধীরে আমাদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে।’ জেলা যুবদলের এই সভাপতি আরো বলেন-ওনার রাজনৈতিক জীবনে ওনি একাধিকবার বাঁক পরিবর্তন করেছেন,সর্বশেষ বাঁক বদলকালে তিনি আমাদের সাথে নূন্যতম কথাও বলেননি,পরামর্শও করেননি। শুধু নিজের স্বার্থ চিন্তা করেছেন। সর্বশেষ তার রাজনীতিবিমূখ কর্মকান্ড,নিজের স্বার্থ ও প্রয়োজনকেন্দ্রিক রাজনীতির কারণে দুরত্ব আরো বেড়েছে।’ জেলা যুবদলের সভাপতি আবু সাদাত সায়েমের সাথে দুরত্ব তৈরি হওয়া নিয়ে তিনি বলেন-‘সায়েম আমার কমিটির সেক্রেটারি,তার সাথে রাজনীতিতে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে এসেছি,কিন্তু সে সেক্রেটারি হওয়ার পর কিছু ‘ভুল বুঝাবুঝি তৈরি হচ্ছে’। সেটা ‘কারো প্ররোচনায়’ নাকি ‘নেতৃত্বেও প্রতিযোগিতা’য় আমি ঠিক জানিনা। তার মাথায় কি কাজ করে,সেটাও বুঝিনা আমি।’ তবে ভবিষ্যতে আবারো তিনজনকেই একই মোহনায় দেখা যাবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে শাকিল বলেন- ‘যেহেতু তিনজনই একই দল করি,একই রাজনীতি ও আদর্শের সৈনিক,সেহেতু ভবিষ্যতে কোন একদিন কোন এক মোহনায় মিলিত হওয়ার সম্ভাবনা তো থেকেই যায়।’
স্কুল-কলেজ জীবন থেকেই ছাত্রদলের রাজনীতিতে সক্রিয় শাকিল জেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি ছিলেন। এখন দ্বিতীয় দফায় জেলা যুবদলের সভাপতি তিনি। আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য রাঙামাটি পৌরসভা নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী হতে চান তিনি।
আবু সাদাত মো: সায়েম
জেলা যুবদলের সাধারন সম্পাদক আবু সাদাত মো: সায়েম বলেন- ‘ভূট্টো মামা’র সাথে আমার ব্যক্তিগত কোন বিরোধ নেই,হয়নি। কিন্তু গত পাঁচ বছর ধরে তিনিও আমার সাথে কথা বলেন না, আমিও বলিনা। বিরোধ নাই কোন,কিন্তু একটা দুরত্ব তৈরি হয়ে গেছে। এটার মূল কারণ হয়তো, আমি জেলা বিএনপির মূল স্রোতধারার সাথেই আছি,নির্বাচিত নেতৃত্বের পেছনেই রাজনীতি করছি,কিন্তু তিনি (ভূট্টো) রাজনীতি করছেন তাদের সাথেই যারা নির্বাচিত মূল নেতৃত্বের বিরোধীতা করে আসছে।’ এটা ছাড়া তার সাথে আমার অন্য কোন বিরোধ নেই।’
জেলা সভাপতি শাকিলের সাথে বিরোধ প্রসঙ্গে কৌশলী উত্তর দেন সায়েম। তিনি বলেন-‘ আমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তিগত বিরোধ বা দ্বন্ধ নেই। নেতৃত্বে প্রতিযোগিতা হয়তো আছে। কিছু ‘ভুল বুঝাবুঝি এবং মতপার্থক্য’ হয়তো তৈরি হয়েছে। তবে এর প্রভাব আমরা সংগঠনের কার্যক্রমে পড়তে দিইনা।
আবারো তিন মামা-ভাগিনার একত্রিত হওয়ার কোন সম্ভাবনা আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে সায়েম বলেন-‘রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। ভূট্টো মামা যদি রাঙামাটি বিএনপির রাজনীতিতে মূল স্রোতধারায় ফিরে আসেন কিংবা জেলা বিএনপির নেতৃত্বে আসেন,তবে আমি এখনকার মতো তখনো তার পেছনেই রাজনীতি করতে বাধ্য।’
স্কুলজীবন থেকেই ছাত্রদলের রাজনীতিতে সক্রিয় সায়েম,রাঙামাটি সরকারি কলেজ ছাত্রদলের সভাপতি,জেলা ছাত্রদলের সভাপতির দায়িত্ব পালন শেষে বর্তমানে রাঙামাটি জেলা যুবদলের সাধারন সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটিরও সদস্য ছিলেন।
জাহিদুল ইসলাম জাহিদ
বর্তমানে আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় জাহিদ ছিলেন এককালে ভূট্টোর খুবই ঘনিষ্ট সহচর ভাগিনা। কিন্তু পরে এই মামা-ভাগিনার সম্পর্ক দা-কুমড়ো সম্পর্কে রূপ নেয়। কিন্তু কেনো ? জাহিদ বলেন-‘ মামা(ভূট্টো)’র পেছনেই সারাজীবন রাজনীতি করেছি। ওনার জন্য সারাজীবন আমরা সবকিছু করেছি,কিন্তু ওনি আমাদের জন্য কিছু করেননি। ওনি শুধু নিজেরটা বোঝেন,আমাদেরটা বোঝার সময় ও ইচ্ছে তার কোনকালেই ছিলোনা। তাই শুধু আমি নয়,পরে শাকিল-সায়েমরাও সরে গেছে। কারণ মামা বড় বেশি স্বার্থপর। তবে রাজনীতির পাশাপাশি কবরস্থান সংলগ্ন পুকুরের ইজারার শেয়ারের লাভের ভাগ নিয়েও তার সাথে আমার বিরোধ তৈরি হয়,সেই কারণেই পরে একেবারেই সরে গেছি।’
বিএনপি ছেড়ে আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে যোগ দেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন-‘ যখন দেখেছি দলটার কোন আদর্শ উদ্দেশ্য নাই,ত্যাগের মূল্যায়ন নাই,টাকা দিয়ে পদ কেনা যায়,জেলা এবং কেন্দ্রীয় নেতাদেরও টাকা দিয়ে পদ পাওয়া যায়,তাছাড়া জামাতের সাথে বিএনপির নীতিহীন ঘনিষ্ঠতার রাজনীতিকে আমি পছন্দ করতাম না, তাই তখন ঘৃণায় এই দল ছেড়েছি।’ রাঙামাটি কলেজ ছাত্রদলের সাবেক সেক্রেটারি,সদর থানা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি,জেলার সাবেক যুগ্ম সম্পাদক হয়ে সর্বশেষ জেলা তৃণমূল দলের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা জাহিদ,বর্তমানে আওয়ামীলীগের সক্রিয় কর্মী হিসেবে কাজ করছেন। পেশায় তিনি একজন শিক্ষানবিশ আইনজীবি।
কি বলছেন মামা ভূট্টো
তিন ভাগিনার অভিযোগ কিংবা অনুযোগ অথবা নানান বক্তব্য প্রসঙ্গে আমরা কথা বলেছি আলোচিত মামা,রাঙামাটি পৌরসভার সাবেক মেয়র ও জেলা বিএনপির সহসভাপতি সাইফুল ইসলাম ভূট্টোর সাথে। শুরুতেই তিনি বলেন-‘ আমার ভাগিনা রাশি খারাপ,কি আর করা!’
তিনি বলেন-‘ওদের তিনজনের জন্মের পর থেকেই ওদের সাথে আমার পরিচয়। ওরা আমার আপন ভাগিনা নয়,পাড়াত ভাগিনা। জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে তাদের সম্পৃক্ত হওয়া,বিকশিত হওয়া এবং বর্তমান অবস্থান তৈরি হওয়ার পেছনে আমি ভূট্টোর ভূমিকা কতটুকু আছে,সেটার সাক্ষী তারা নিজেরাই। তাদের কার জন্য কি করেছি আমি,সেটার খোঁটা দিবনা আমি,কারণ আমি ছোটলোক নই।’
ওদের সাথে বিরোধ তৈরি হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন- আমাকে খাওয়া শেষ হওয়ার পর সায়েম-শাকিলের মনে হয়েছে,আমার প্রয়োজন শেষ,আমার কাছে আর কিছুই নাই,তাই তারা নিজেদের পথ বেছে নিয়েছে। এটা নিয়ে আমার কোন আপসোস নেই,ক্ষতিও নাই। বরং ওরা সরে যাওয়ায় আমি আপদমুক্ত হয়েছি। কারণ ওদের কারণে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি,বিতর্কিত হয়েছি,আর্থিকভাবেও অনেক লোকসান হয়েছে।’
ভবিষ্যতে আবার তিনজনকে একসাথে দেখা যাবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ভূট্টো বলেন- আমি আগামীতে জেলা বিএনপির সভাপতি অথবা সাধারন সম্পাদক প্রার্থী হব এবং আমি নিশ্চিত যে আমি বিজয়ী হব। তখন ওরা ওদের প্রয়োজনেই আমার কাছে আসবে,আমি তাদের কাছে যাবনা। তখন তাদের সাথে রাজনৈতিক সম্পর্ক থাকবে,ব্যক্তিগত সম্পর্ক পুন:প্রতিষ্ঠার আর কোন সম্ভাবনাই নেই।
শাকিল ‘ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এবং পৌর কাউন্সিলর রবিকে মারধরের ঘটনায়’ দূরে সরে গেছে,সায়েম ‘তার বন্ধু আকবরকে মেয়র হিসেবে বিজয়ী করতে’ কৌশলে সরে গেছে আর জাহিদ ‘বিশ্বাসভঙ্গ করে পুকুর লিজের টাকা নিজের একাউন্টে’ নিয়ে যাওয়ার পর তার সাথে সম্পর্ক চিরতরে শেষ হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করে সাবেক এই পৌর মেয়র বলেন-‘আমি আগামীতেও পৌর নির্বাচন করব। ওদেরকে বলে দিয়েন,ওদের ভোটও আমার দরকার নাই। ওদেরকে ছাড়াই আমি এবং আমার আগামীর রাজনীতি ও জীবন পরিচালিত হবে। ’
রাঙামাটির জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে ‘খেয়ালী রাজনীতিবিদ’ ভূট্টো রাঙামাটি সরকারি কলেজ,রাঙামাটি জেলা ছাত্রদলের নেতা ছাড়াও রাঙামাটি জেলা যুবদল,পৌর বিএনপি হয়ে এখন জেলা বিএনপির সহসভাপতি হিসেবে রাজনীতি করছেন। জেলার রাজনীতিতে প্রভাবশালী এই নেতা রাঙামাটি পৌরসভায় বিএনপির প্রথম মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হয়ে চমক সৃষ্টি করেছিলেন এবং সর্বশেষ নির্বাচনেও সকাল সাড়ে দশটায় ভোট বয়কট করা সত্ত্বেও চট্টগ্রাম বিভাগে বিএনপির প্রার্থীদের মধ্যে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে চমকে দিয়েছিলেন সবাইকে। আগামী পৌরসভা নির্বাচনেও বিএনপির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করবেন বলে ইতোমধ্যেই জানিয়েছেন তিনি।
মামা ভূট্টো আর তার তিন ভাগিনা জাহিদ-শাকিল-সায়েম যেনো এখন পৃথক পৃথক চারটি নদী। অথচ একদিন তারা ছিলেন মামা নদীর তিন ভাগিনা মোহনা। তিনজন এখনো একই দল করলেও ইতোমধ্যেই একজন দল ছেড়ে পাড়ি দিয়েছেন অন্য দলে। তবুও জীবনের মতো রাজনীতিতেও শেষ বলে কিছু নেই। আসছে কোনদিনে আবারো কোথায় কোন মোহনায় তারা আদৌ মিলিত হবেন কিংবা হতে পারবেন কিনা সেটা সময়ই বলতে পারবে।