খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় ভারতীয় এক নাগরিক ‘সাধক মা’ পরিচয়ে সর্বরোগের চিকিৎসার নামে আস্তানা গেড়েছেন। মন্ত্র পাঠ করে ফুল, ফল দিয়ে চিকিৎসা দিচ্ছেন দুর দুরান্তর থেকে আগত রোগীদের। তাঁর কাছে চিকিৎসা নিতে চাকমা, বাঙালি ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের হাজারো লোক রোগী নিয়ে ভিড় জমাচ্ছেন। সারাদিন ধরে হাজারো মানুষের সমাগমকে কেন্দ্র করে সেখানে গড়ে উঠেছে অস্থায়ী বাজার। অপরদিকে সাধক মা মন্দিরের দেব-দেবীর প্রতিমাকে অবমাননা করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ করছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। এ নিয়ে ত্রিপুরা সম্প্রদায় ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে তিক্ততা বাড়ছে।
ভারতীয় এ নাগরিকের চিকিৎসার নামে প্রতিদিন হাজারো লোকের সমাগমকে ঘিরে এলাকায় চলছে আলোচনা, সমালোচনা। দরিদ্র পরিবারের অসচেতন লোকেরা রোগী নিয়ে ভিড় করলেও এ বিরুদ্ধে প্রশাসন ব্যাবস্থা গ্রহণ না করায় অনেকে আবার ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির এক নেতা তাঁর ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, ‘ডিজিটাল যুগে এ ধরনের ভন্ডামির বিরুদ্ধে প্রশাসন কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না।’ আবার বিশেষ একটি সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি ধর্মীয় মন্দির ব্যবহার করায় তাদের বিরুদ্ধে কিছু বললে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অজুহাত তোলে এলাকায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশংকায় অনেকে প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন না। তবে ঘটনাস্থলে মন্দিরের প্রতিমাকে অবমাননার অভিযোগে স্থানীয় ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের সাথে হিন্দু সম্প্রদায়ের উত্তেজনা দেখা দিলে স্থানীয় সেনাবাহিনী গিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করে।
অপরদিকে বিষয়টি নিয়ে হাসপাতালের চিকিৎসক বলছেন ‘এসব অপচিকিৎসা’। আর পুলিশ প্রশাসন বলছে, ‘বিষয়টির খোঁজ নেওয়া হচ্ছে’।
এ ঘটনা উপজেলার সনাতন ধর্মাবলম্বী ত্রিপুরা সম্প্রদায় অধ্যুষিত বৌদ্ধ পাড়ায়। আর ‘সাধক মা’ ও এসেছেন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে। এ সাধক মা একদিন পুরুষের পোষাক পরিধান করেন, আরেকদিন নারীর পোষাক পড়েন। তবে তাঁর চাল-চলন, বাচন ভঙ্গি পুরো হিজরার মতো। সোমবার সেখানে গিয়ে দেখা গেছে বৌদ্ধ পাড়া শিব মন্দিরের অদুরে অস্থায়ী বাজারের সামনে বাঁশ দিয়ে তৈরি গেট করে চিকিৎসা নিতে আসা হাজারো লোকজনকে আটকে রাখা হয়েছে। কারণ, ভিতরে চিকিৎসা নিতে লাইনে অপেক্ষমান রয়েছে কয়েক’শ লোক। তাদের একাংশ ফিরলেই এখান থেকে ভিতরে যাওয়ার জন্য কিছু লোক ছাড়া হবে। রোগমুক্তির আশায় গেইটে লোকজনও ধৈর্য নিয়েই ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করছেন। প্রায় তিনশ গজ দুরের এ গেইটেই জুতা খুলে রেখে যেতে হয়। ভিতরে জুতা পায়ে এবং কোন ক্যামেরা ব্যবহার নিষেধ। কিন্তু সেই সাধক মায়ের সাথে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে একান্তে আলোচনা করে ছবি তোলার অনুমতি পাওয়া যায়। নিবিড়ভাবে কথাও বলেছেন তিনি। সেদিন তিনি ছিলেন ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের পুরুষের পোষাক পরিহিত।
ভিতরে দেখা যায়, শিব মন্দীরের আঙ্গিনায় পলিথিনের ছাউনি দিয়ে রোগীদের লাইন ধরে বসার জায়গা করা হয়েছে। কিন্তু সে ছাউনিতেও জায়গা হচ্ছে না, ছাউনির ভিতরের চেয়ে বাইরে লোক রোগীর সংখ্যা বেশি।
আগত রোগী এবং তাঁদের স্বজনদের সাথে কথা বলে রোগ ভাল হওয়া না হওয়ার পক্ষে-বিপক্ষেই বক্তব্য পাওয়া গেছে। খাগড়াছড়ির ৩নং যৌথখামার এলাকার অপর্ণা চাকমা জানান, তিনি দুই বছর ধরে পক্ষাঘাতগ্রস্থ ছিলেন এই সাধক মা’র কাছে এসে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েছেন। কিন্তু বৌদ্ধ পাড়ার পাড়ার পার্শ¦বর্তি থানা পাড়া গ্রামের আরেক নারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তিনি স্বামীকে না জানিয়ে বেশ কয়েক দিন ধরেই এখানে আসছেন; কিন্তু তাঁর শারিরীক সমস্যার কোনও পরিবর্তন হয়নি।
চিকিৎসা দেওয়া প্রত্যক্ষ করার সময় লাইনে বসে ছিলেন থানা পাড়ার জরিনা খাতুন (৫৫)। তাঁর সম্যসার কথা সাধক মা জানতে চাইলে তিনি জানান, কন্ঠনালীতে মারবেলের মতো এক গুঁটি আছে বলে অনুভব হয়। দীর্ঘদিন ডাক্তারের নিকট চিকিৎসা নিয়েও সুস্থ হননি। শোনার পর সাধক মা মন্ত্র পাঠ করে জানতে চাইলেন গুটিটি চলে গেছে কি-না? রোগীর উত্তর রয়ে গেছে। এর পর সাধক মা ওই রোগীর গলায় হাত দিয়ে মন্ত্র পাঠ করে জানতে চাইলেন, কিন্তু না কোন পরিবর্তন নাই। এভাবে সাধক মা ওই রোগী নিয়ে প্রায় ১৫ মিনিট চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর জানালেন এটি সারবার মতো নয়, তাঁর গলায় দেবতার দৃষ্টি রয়েছে। পরদিন ৫টি ফুল ও ৫টি ফল নিয়ে আসার পরামর্শ দিলেন। একইভাবে অপর এক নারী তাঁর মেয়েলি সংক্রান্ত সমস্যার কথা জানিয়ে বললেন তাঁর সন্তান হয় না। সে নারীকেও মন্ত্র পাঠ করে দিয়ে পরবর্তীতে স্বামীসহ আসার পরামর্শ দিয়ে বিদায় দিলেন।
দেখা রোগীরা যে যার মতো টাকা দিচ্ছেন, আর সে টাকা সাধক মা’র সাথে থাকা একজন একপি ব্যাগে ভরে রাখছেন। সাধক মা’র সাথে আরেকজন রয়েছেন ভাষা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য।
কথা হয় সেই সাধক মা’র সাথে। তাঁর কথা বার্তা, অঙ্গভঙ্গি হিজরার মতোই। সেভ করা মুখ দেখলেই স্পট বোঝা যাচ্ছে। জানালেন, বাবা মায়ের দেওয়া তাঁর নাম চরিত্র দেব বর্মা আর মহাদেব তাঁর নাম রেখেছেন শান্তি দেবী। এখন তিনি শান্তি দেবী নামেই পরিচিত। তবে তিনি নিজেকে পুরুষ দাবি করেছেন। শান্তি দেবী আরো জানান, তিনি একদিন চৌদ্দ দেবতার সাধনা করে মানুষের রোগমুক্তির ক্ষমতা অর্জন করেছেন। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার ছেরামি থানার রামকৃষ্ণ গ্রামের মুনিরাম দেব বর্মার সন্তান তিনি। প্রায় দেড় মাস আগে অবৈধ পাথে ভারতের রইসা পাড়া দিয়ে সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে এসেছেন। শান্তি দেবী দাবি করছিলেন, তিনি নারী ও পুরুষ দুই রুপ ধারণ করতে পারেন। এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, শারিরীকভাবে নয় শুধু নারী ও পুরুষের কাপড় পরিধান করে থাকেন। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তিনি চৌদ্দ দেবতার ভক্ত। কয়দিন থাকবেন, কোথায় যাবেন এসব প্রশ্নের জবারে বালেন, ‘সব ভগবানের কৃপায় হবে’।
একদিন পর গত মঙ্গলবার গিয়ে দেখা যায় ভিন্ন এক চিত্র। আগত রোগীদের অনেকেই ফিরে যাচ্ছেন। সবার মুখে মুখে একই কথা, কার অবমাননার কারণে সাধক মা নাকি সাপ হয়ে গেছেন। ভিতরে যাওয়া সকলের নিষেধ। তবুও বিশেষ অনুমতি নিয়ে ভিতরে গিয়ে দেখা যায়, মন্দিরের আঙ্গিনায় সাধক মা চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন। চার পাশে অনুসারিরা আগর বাতি জ্বেলে তঁাঁর মঙ্গল কামনা করছেন। পাশে একটি বাটিতে দুধ রাখা আছে। কিছুক্ষন পর সাপের ভঙ্গিমায় সাধক মা উঠে একই ভঙ্গিমায় বাটির দুধটুকু খেয়ে নিলেন। পর ঢুকলেন পাশের শিব মন্দিরে। সেখানে শিব লিঙ্গ ধরে অনেকক্ষণ বসে থাকলেন। নেমে এসে পাশের আস্তানায় গিয়ে ¯œান সেরে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের নারীর পোষাক পরে গেলেন পার্শ্ববর্তি কালী মন্দিরে। সেখানে গিয়ে দেবী কালীর প্রতিমার সামনে জিহ্বা বের করে কালীর একই ভঙ্গিমায় শিবের প্রতিমার ওপর দাঁড়ালেন। সে মন্দিরের পুরোহিত তাঁর নাম (শান্তি দেবী) নিয়ে পূজা অর্চনা করলেন। কালীর প্রতিমার সামনে রাখা প্রসাদও ভক্ষণ করলেন সাধক মা। এর পর একটি পাঠা বলিও দেওয়া হলো। আবার ফিরে শিব মন্দিরে শিব লিঙ্গের পের দাঁড়ালেন আর পুরোহিতসহ তাঁর অনুসারীরা সেখানেই ডাবের জল দিয়ে সাধক মার পা ধুইয়ে পূজা অর্চনা সারলেন। এর পর আবার শুরু হলো চিকিৎসা প্রদান।
সাপ হওয়ার কাহিনীর বিষয়ে সাধক মা’র ভক্ত দীপংকর নারায়ণ ত্রিপুরা জানান, মায়ের শক্তি একটি ত্রিশূলে। যেটাতে দেব শক্তি যোগান। সে ত্রিশূল যেখানে রাখা আছে সেখানে সকলেই পূজা করে থাকে। আর এক আগন্তুক সে ত্রিশূলে কুলি (মুখের ভিতরের ময়লা পানি) দিলে মায়ের এরকম কষ্টের পরিণতি হয়। তাঁর দাবি সে লোক নিশ্চয়ই তান্ত্রিক, মায়ের ক্ষমতা নষ্ট করার জন্য এ কাজ করেছিল। তবে সাধক মা তা কাটিয়ে উঠেছেন।
হিন্দুদের মধ্যে বিরোপ প্রতিক্রিয়াঃ দীঘিনালা উপজেলা সনাতন ছাত্র ও যুব পরিষদের সভাপতি জীবন চৌধুরী উজ্জ্বল ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে জানান, ভগবান সমতুল্য শিবের প্রতিমার পের এই ভন্ড পা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে যা ধর্মের জন্য চরম অবমাননাকর। এর প্রতিবাদ করতে গেলে স্থানীয় ত্রিপুরা সম্প্রদায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। উজ্জ্বলের ভাষায়, রোগমুক্তির নামে মানুষকে হয়রানিকারী এ ভন্ডের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনী ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। একই প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করেছেন, উপজেলা সনাতন সমাজ কল্যাণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নিউটন মহাজন।
দীঘিনালা উপজেলা হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার ডাঃ মো. নুরুল আনোয়ার জানান, এধরনের চিকিৎসার বিজ্ঞানসম্মত কোন ভিত্তি নাই। ধর্মকে পুঁজি করে মানুষকে ঠকানো হচ্ছে। এবং এক শ্রেণির লোকজন ব্যবসা করছেন। প্রশাসন এর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিবে বলে তিনিও আশা করছেন।
দীঘিনালা থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান (ওসি, তদন্ত) জানান, জানা গেছে এলাকায় এর পক্ষে-বিপক্ষেই লোকজন রয়েছে। তবে রাষ্ট্রবিরোধী এবং ধর্মবিরোধী কোন কাজ করা হচ্ছে কিনা এছাড়া বাংলাদেশে প্রবেশে তাঁর কোন বৈধতা আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
4 Comments
গনদোলাই দেওয়া হোক
ঐ এলাকার ছাগল আর ছাগীরা ধর্মের ধ না বুঝে ভন্ডকে প্রনাম করতেছে।
হাসবো নাকি রাগ করবো বুজতে পারছিনা।
আজব কারাকানা দুনিয়াতে।
একে হাত পা কেটে দেওয়া হোক।