২৭ এপ্রিল সোমবার বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের বীরউত্তমের ৪৯তম শাহাদাত বার্ষিকী। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসর মিজুবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে খাগড়াছড়ির মহালছড়িতে শহীদ হন তিনি। অকুতোভয় এই বীরের লাশ রামগড় কবরস্থানে এনে দাফন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ স্বাধীনতার পর তাঁকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। গুইমারা সেনা রিজিয়ন এর সাবেক কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তোফায়েল আহমেদ পিএসসি রামগড়ে এক অনুষ্ঠানে জানান,শহীদ ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের বীরউত্তমই হচ্ছেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধে প্রথম শহীদ সেনা কর্মকর্তা।
শহীদ আফতাবুল কাদেরের বীরত্বগাথা এখনো ভুলতে পারেননি রামগড়ের মানুষ। দেশমাতৃকার জন্য এই বীর সেনানীর আত্মদান কিংবদন্তী হয়ে আছে এই এলাকার মানুষের কাছে।
ওয়েবসাইট ঘেঁটে জানা যায়, ১৯৪৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর দিনাজপুর শহরে আফতাবুল কাদেরের জন্ম। পিতা মরহুম এম আবদুল কাদের ছিলেন ব্রিটিশ আমলের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। মা রওশন আরা বেগম গৃহিনী। পিতার গ্রামের বাড়ি ল²ীপুর জেলার রামগঞ্জ থানার টিওরী গ্রামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ অনাসর্ (ইংরেজি) শ্রেণীর ছাত্র থাকা কালে ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সেনা বাহিনীর কর্মকর্তা পদে নির্বাচিত হন।
কমিশন লাভের জন্য পাকিস্তানের কাকুল মিলিটারি একাডেমিতে দু বছরের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণে যোগ দেন। আর্টিলারি কোরে ১৯৬৯ সালে কমিশন প্রাপ্ত হন। ১৯৭০ সালে ক্যাপ্টেন পদোন্নতি পেয়ে হায়দ্রাবাদ ক্যান্টনমেন্টে ৪০ ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টে পোস্টিং পান। ১৯৭১ এর ৫ ফেব্রæয়ারি ৪০ ফিল্ড রেজিমেন্টের বাঙ্গালি কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের ছুটি নিয়ে ঢাকায় আসেন । কিন্তু ছুটি শেষে কর্মস্থলে ফিরে না গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। ২ এপ্রিল রাতে রামগড় শহরে এসে পৌঁছান। ওই সময় মেজর জিয়া রামগড়ে ঘাঁটি করে যুদ্ধ করছিলেন। শুরুহয় ক্যাপ্টেন কাদেরের ব্যস্ততা। চট্টগ্রাম পার্বত্যচট্রগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলের প্রায় পাঁচ শতাধিক তরুনকে জড়ো করে রামগড় উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে খোলেন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
২০ এপ্রিল ক্যাপ্টেন কাদের ও ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান ৫০ সদস্যের একটি সেনা দল সহ মেজর জিয়াকে নিয়ে মহালছড়ি পৌঁছান, তখন মহালছড়িতে ছিল মেজর শওকতের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যূহ। মেজর শওকতকে রামগড় ফিরে আসার পরামর্শ দিয়ে মেজর জিয়া নিজেও চলে আসেন কৌশলগত কারণে। মহালছড়িতে অবস্থান করেন ক্যাপ্টেন কাদের। রাঙ্গামাটি,কাপ্তাই ও মানিকছড়ির বিভিন্ন রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেন তিনি। ২৪ এপ্রিল মেজর শওকতের নির্দেশে রাঙ্গামাটি ছেড়ে মহালছড়ি ফিরে আসার সময় শত্রæসেনাদের প্রবল আক্রমনের মুখে পড়েন ক্যাপ্টেন কাদের। ওই সময় সমস্যা দেখা দেয় ভারতের মিজোরামের দুটি বিদ্রোহী মিজো ব্যাটালিয়ন নিয়ে। তারা তখন মহাল ছড়িতে খুবই সক্রিয় ছিল। পাকসেনাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মুক্তিবাহিনীর ওপর হামলা করছিল তারা। পাহাড়ি এলাকার সমস্ত পথঘাট ছিল তাদের চেনাজানা। তাই পাহাড়ে চলাফেরা ও যুদ্ধে অনভ্যস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের খুবই অসুবিধা হচ্ছিল। তারপরও সর্বশক্তি প্রয়োগ করে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। উদ্দেশ্য একটাই রামগড়ের পতন বিলম্বিত করা।
২৭ এপ্রিল পাকসেনা ও মিজোবাহিনীর অতর্কিত হামলায় মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে হতাহত হন। সকাল নয়টায় মুক্তিবাহিনীর মহালছড়ি অবস্থানের ওপর একটি মিজো ব্যাটালিয়ন (১০০০সৈন্য) পাকবাহিনীর সঙ্গে একত্রিত হয়ে আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা বীর বিক্রমে শত্রæদের হামলা প্রতিরোধ করে যাচ্ছিলেন। পাহাড়ে লুকিয়ে মিজো ব্যাটালিয়ন ও পাকিস্তানি কমান্ডোরা গুলি করছিল।
ক্যাপ্টেন কাদের দু জন ইপিআর সৈনিককে এলএমজি নিয়ে তাঁর সঙ্গে থাকতে বলেন। ওই সময় ছাত্র শওকত ও ফারুক ক্যাপ্টেন কাদেরের সঙ্গেই ছিলেন। মুর্হুমুহু গুলিবর্ষণের মধ্যেই শত্রæসেনাদের প্রতিরোধ করছিলেন তারা।
এমন সময় শত্রæদের গুলি এসে বিঁধে ক্যাপ্টেন কাদেরের বুকে। তখন বিকাল তিনটা। প্রবল গুলিবর্ষণের মধ্যেই ছাত্র শওকত ও ফারুক মারাতœকভাবে আহত ক্যাপ্টেন কাদেরকে কাঁধে নিয়ে পাহাড় বেয়ে নেমে আসেন রামগড় যাওয়ার উদ্দেশ্যে। রামগড় পৌঁছাতে পারলে হয় তো ক্যাপ্টেনকে বাঁচানো যাবে। কিন্তু গুইমারা এসে পানি পান করেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মুক্তিযুদ্ধের সূর্যসৈনিক ক্যাপ্টেন আবতাবুল কাদের। তাঁর মৃতদেহ রামগড় এনে সমাহিত করা হয়। রামগড় জামে মসজিদের ইমাম মোস্তফা হুজুর তাঁর জানাজা পড়ান।
শহীদ ক্যাপ্টেন কাদের এর নামে খাগড়াছড়ি ও রামগড়ে সড়ক ও শহীদ ক্যাপ্টেন কাদের বিদ্যানিকেতন নামে প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সহ সভাপতি বেলাল হোসাইন ও শিক্ষক আনিছুর রহমান জানান, প্রতিবছর এই দিনে তাঁকে রামগড়ের মানুষ গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করেন।