ইতিহাসে সম্ভবত: এমন কিছু বছর আসেই,যখন কষ্ট,বেদনা,হতাশারা কুঁড়ে কুঁড়ে খায় পুরো নিজস্ব পৃথিবীটাই। বেদনায় নীল হয়ে যায় জীবন। ২০১৭ সাল পার্বত্য রাঙামাটিবাসির জীবনে এমনই একটি বছর হিসেবেই চিহ্নিত হবে।
২০১৭ সালের ৩ জুন রাঙামাটির লংগদু উপজেলায় মোটর সাইকেল চালক ও ওয়ার্ড যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়ন হত্যাকান্ডের ঘটনার জেরে নির্বিচারে পুড়িয়ে দেয়া হয় দুই শতাধিক পাহাড়ীদের বাড়ীঘর। মুহুর্তেই গৃহহীন হয়ে পড়েন নয়ন হত্যার সাথে দূরতম সম্পর্ক না থাকা পরিবারগুলো। দেশে বিদেশে ব্যাপক সমালোচিত হয় ঘটনাটি। সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রী ও কর্মকর্তারা ছুটে যান সেখানে। ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহে আটক করা হয় অসংখ্য মানুষকে। সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হয় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের। কিন্তু নানা জটিলতায় এখনো শেষ হয়নি পুনর্বাসন। এই ঘটনাটি রাঙামাটির সম্প্রীতির উপর বড় ধরণের আঘাত হিসেবেই সামনে আসে।
২০১৭ সালের ১২ জুন। টানা বর্ষণে বিপর্যস্ত পার্বত্য শহর রাঙামাটি। এমন বৃষ্টি দেখেনি এই জেলার মানুষ। কিন্তু কে জানতো এই টানা বৃষ্টিই কি ভয়ংকর মরন ফাঁদ হয়ে উঠেছে। ১৩ জুন সকাল থেকেই একে একে আসতে থাকে মৃত্যুর খবর। শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত,জেলার এক উপজেলা থেকে আরেক উপজেলায়,পাহাড় ধসে যেনো মৃত্যু আর লাশের মিছিল শুরু হয়। সারাদেশ থেকে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে পার্বত্য এই জেলা। উদ্ধার করা হয় ১২০ জনের মৃতদেহ। এদের মধ্যে ৫ সেনা কর্মকতা ও সদস্যও ছিলেন। বিস্ময়ে-শোকে-বিহ্বলতায় হতবাক হয়ে যায় পুরো দেশ,পুরো বিশ্ব। পাহাড় ধসে এইভাবে মানুষের গণ মৃত্যু হতে পারে,কেইবা জানতো। দেশি বিদেশী মিডিয়ায় চলে আসে রাঙামাটির নাম। সারাদিন টেলিভিশন চ্যানেলে শুধুই পার্বত্য রাঙামাটি,পাহাড়ধস আর মৃত্যুর খবর। জেলা শহর ও উপজেলায় খোলা হয় ১৯ টি আশ্রয়কেন্দ্র,যাতে ঠাঁই নেয় কয়েক হাজার মানুষ। যাদের তিনবেলা থাকা ও খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। সারাদেশের মানুষ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসেন,শহরের তরুণরা স্বেচ্ছাসেবি হিসেবে ছুটে যান আশ্রয়কেন্দ্রে। অবাক বিস্ময়ে পুরো পৃথিবী যেনো দেখেছে অন্য এক রাঙামাটি,অন্য এক বাংলাদেশকে। টানা তিনমাস আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলো এসব মানুষ। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি বদলাতে থাকে,একে একে বাড়ি ফিরতে শুরু করে বিপন্ন এসব মানুষ,স্বাভাবিক হয়ে আসে জীবন।
কিন্তু এই যে আকস্মিক পাহাড়ের ক্ষেপে উঠা, এমন ভয়ংকর পাহাড়ধস নিয়ে আলোচনা থামেনা। রাঙামাটিতে আসেন দেশি বিদেশী বিশেষজ্ঞরা। চলে পরিদর্শন আর পর্যবেক্ষন। নানান জনের নানান মত আর পরামর্শ। আসে নানা সুপারিশও। পাহাড়ধসে কারণ নির্ণয়ে গঠিত হয় জাতীয় কমিটিও। এখনো চলছে গবেষনা ও কারণ খোঁজা। হয়তো চলবেও আরো অনেক দিন। কিন্তু বাস্তবতা হলো ফিরে আসবেনা ১২০ টি প্রাণ,লাল মাটির দেশে লাল মাটির নীচেই যাদের সলিল সমাধি হয়েছে।