॥ ললিত সি. চাকমা ॥
‘এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়’ কথাটি কবি খুব আবেগ দিয়ে প্রকাশ করেছেন বলে মনে হয় না। বরং প্রকৃতির অকৃত্রিম আবেদনকে বুঝাতে গিয়ে হয়তো পংক্তিখানা তুলে ধরেছেন। ষড়ঋতু ময়তার এ দেশে ঘুরে বেড়ানোর উৎকৃষ্ট সময় হিসেবে শীতকাল ও বসন্তকে গণ্য করা হলেও এর বিপরীতে কালের জটরে লুকিয়ে রয়েছে ঘুরে বেড়ানোর অমিত সম্ভাবনাময় তিনটি ঋতু যথা গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শরৎকাল। এ তিনটি ঋতুর সাথে দেশের পাহাড় তথা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের নৈসর্গিক ও ব্যবহারিক আবেদনের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিদ্যমান। ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে পাহাড়ের রূপবৈচিত্র ভিন্ন ভিন্ন। প্রকৃতির ঋতুভিত্তিক এ আবেদনগুলোর ব্যাপারে দেশবাসীর অজানা বলেই রূপ-গুণে ভরা এ ঋতুগুলোকে ব্যবসায়িক বিবেচনায় পর্যটন শিল্পে ‘অফ সিজন’ বলে অভিহিত করা হয়। অথচ নৈসর্গিক প্রাচুর্য্যে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ এ ঋতুসমূহ হতে পারে দেশীয় পর্যটকদের কাছে পরম আগ্রহের বিষয়। প্রয়োজনীয় প্রচার-প্রচারণা ও তথ্য-উপাত্তের অভাবে এ সকল ঋতুতে ঘুরে বেড়ানোর আকর্ষণ মৃয়মান থেকেছে দেশীয় পর্যটকের কাছে। অথচ একটু কৌশলী প্রচারণার মাধ্যমে সেই ‘অফ সিজন’ হয়ে উঠতো পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটনে ‘পিক সিজন’ বলে।
অফ সিজনের কালেমার তিলক পরা এ গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শরৎ ঋতু প্রকৃতি এবং জনজীবনে প্রাচুর্য্যরে যে সংযুক্তিগুলি ঘটায় তা একটু দেখে নেওয়া যাক।
ক) গ্রীষ্মকালঃ উঞ্চমন্ডলীয় দেশ বলে এ ঋতুটি আমাদেরকে বেশ তাপ এবং কষ্ট দেয় বটে। তবে ফলোৎপাদী ঋতু হিসেবে এর কদর কোন অংশে কম নয়। বলা হয়ে থাকে ‘জৈষ্ঠ্য মাস, মধুর মাস’। এ মধুর মাসে জাতীয়ফল কাঠাল, আম, লিচু, আনারস, জাম, জামরুলসহ নানা রকম পাহাড়ি মৌসুমীফল পাকার ধুম পড়ে। সমতলের তুলনায় পাহাড়ের কৃষি ব্যবস্থা এখনও অনেক বেশী নিখাদ ও অর্গানিক। কাজেই এ সব অর্গানিক কৃষিজপণ্য উৎস থেকে সরাসরি খেতে এবং সাথে করে নিয়ে যেতে হলে গ্রীষ্মকালকে টারগেট করতেই হবে। কেউ কেউ বলতে পারেন, পাহাড়ের এসব ফলমূল তো আমাদের নিজ নিজ এলাকায়ও পেতে পারি। পেতে পারেন নিশ্চয়ই। তবে খামার থেকে বাজারে পৌছার যে অর্ন্তবর্তীকাল সেখানে যে ব্যবসায়ীদের দ্বারা ক্ষতিকর রাসায়নিক মিশানো হচ্ছেনা তার নিশ্চয়তা কোথায়?
বর্ষাকালঃ শীতকালে শুকনো রাস্তাঘাট, সহনীয় তাপমাত্রা এবং সন্তানদের স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় দেশের মানুষ হয়তো ঘুরাঘুরির জন্যে শীতকালকে বেছে নেয়। কিন্তু যৌবনবতী ঝর্ণা, সবুজ পাহাড়, চেঙ্গী, মাইনী, কাচালং, কর্ণফুলী, সাঙ্গুর কলকলিয়ে ধেয়ে যাওয়া জলস্রোত, হাত বাড়ালেই স্নিগ্ধ মেঘ, এপাড়-ওপাড় ছুয়ে থাকা বিস্তীর্ণ কাপ্তাই হ্রদ, বিরূপ প্রকৃতিতে লড়াই করে টিকে থাকা পাহাড়ি জনপদের সংগ্রামী প্রচ্ছদ কিংবা জলযানে করে চড়ে বেড়ানোর সুপ্রসারিত জলপথ এসবের তো শীতকালে পাওয়ার নয়। আগ্রহী খাদকের কাছে বাচ্চুরী তথা বাঁশ কোরল এর বিভিন্ন স্বাদের তরকারী এ ঋতুতেই মিলবে। বর্ষাকালেই প্রকৃতির এসব ঐশ্বর্য মিলে। এসব কিছুর দেখা পেতে হলে পর্যটককে অবশ্যই পাহাড় ভ্রমণে বর্ষাকালকে বেছে নেওয়ার দাবি রাখে।
শরৎকালঃ কাপ্তাই হ্রদের নীল জলরাশি, সবুজ বনানীর ওপর দিগন্তজোড়া নীল আকাশ, শ্বেত-শুভ্র জমাট মেঘের ভেলা, জুমের সোনালী পাকাধানক্ষেত, জুুমিয়াদের নবান্ন উৎসব, জুমের নানাবিধ ফসলসহ মারফাূচিন্দিরা খেতে পাওয়ার ঋতুই হল শরৎকাল। এই মেঘ, এই বৃষ্টির এমন খেলা পাহাড়ের খাজে খাজে মিলে যাওয়ার, উচু নীচু পাহাড়ের সবুজ গালিচায় রোদ আর মেঘের প্রচ্ছায়ায় সৃষ্ট হওয়া বর্ণিল প্রকৃতির ছবি তো শুধু শরতেই পাওয়া সম্ভব। তদুপরি রয়েছে পাহাড়ের বৌদ্ধদের প্রবারণা ও ফানুস উড়ানো উৎসব!
সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে কাপ্তাই হ্রদে বেড়ে চলেছে হাউজ বোটের সংখ্যা। সে হাউজবোট গুলোর ব্যবসা খুব একটা মন্দ নয়। পাহাড়ের ক্রাশ সাজেক দেখতে যাওয়া পর্যটকের সংখ্যাটাও নেহায়েত কম নয়। বন বাঁদারে ঘুরে বেড়ানো এডভেঞ্চার প্রেমীদের সংখ্যাও কি কম? সে সাথে যুক্ত হয়েছে ক্যাম্পিং তথা তাঁবুতে থাকার ট্রেন্ড। রাঙামাটিতে রাইন্যা টুগুন ইকো রিসোর্টসহ বেশ কয়েকটি রিসোর্টে এখন তাঁবুতে থাকার সুবিধা বিদ্যমান। মুলত বাজেট ট্রাভেলাররাই এসব সুবিধা গ্রহণ করছে।
সময় যতই গড়াচ্ছে সরকারি-বেসরকারি পর্যটন শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এবং তাদের সেবার পরিসর বাড়ছে। এখন শহরের বাইরেও নিরিবিলি পরিবেশে অবকাশ যাপনের সুবিধাদানের লক্ষ্যে রিসোর্টগুলো গড়ে উঠছে। সাধ ও সাধ্যের বিবেচনায় সব শ্রেণির পর্যটক পেয়ে যাবেন তাদের কাক্সিক্ষত সুবিধা; সে লক্ষে বিকশিত হচ্ছে পর্যটন সেক্টর।
অফ সিজনের এঋতুগুলিতে মুলত সলো ও গ্রুপ ট্রাভেলাররা ট্রাভেল করতে দেখা যাচ্ছে যাদের বয়স ৪০ এর নীচে। কাজেই নিজেদের পছন্দানুসারে এডভেঞ্চারপ্রেমীরা এসময়টাকে বেছে নিচ্ছে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ানোর সময় হিসেবে।
দেশের মধ্যে শীর্ষ পর্যটন গন্তব্য হিসেবে কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিনের নাম সুবিদিত। অন্যদিকে সুন্দরবন ও হাওর এর নাম যুক্ত হয়েছে পর্যটনের গন্তব্য হিসেবে। এসব স্থানে পর্যটকদের ভীড় গ্রীষ্মূবর্ষাূশরতে কিছুটা কমে যায় কারন বর্ষাকালে কক্সবাজার আকর্ষন হারায়, সেন্টমার্টিন হয়ে ওঠে দুর্গম। হাওর ও সুন্দরবন পানি, বন্যা এসবের কারণে ভ্রমণের আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে এ সময়ে। কাজেই সারা দেশের পর্যটন খাত যখন সুপ্ত অবস্থায় থাকে সে সময়ে পর্যটকদের পাহাড়মুখি করতে পারলে স্থানীয় অর্থনীতি চাঙ্গা হতো। মান্রষের জীবনূমানের দ্রুত ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটতো।
লেখক: পর্যটন উদ্যোক্তা