দেশের প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ মহাকাশে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে শেষ মুহূর্তে এসে আটকে গেলে স্যাটেলাইটটির উৎক্ষেপণ সফলভাবে শেষ হয়েছে শুক্রবার রাতে। কারিগরি জটিলতার সমাধান শেষে উৎক্ষেপণ হয়েছে বলে জানিয়েছে উৎক্ষেপণকারী প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স। শুক্রবার দিবাগত রাতে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অরল্যান্ডোর কেপ কেনেডি সেন্টার থেকে স্থানীয় সময় বিকাল ৪টা ১৪ মিনিট থেকে ৬টা ২০ মিনিটের (বাংলাদেশ সময় শুক্রবার দিবাগত রাত ২টা ১৪ মিনিট থেকে ৪টা ২০ মিনিট) স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপ করা হয়। ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোর কেপ কেনেডি সেন্টারের লঞ্চিং প্যাড থেকে মহাকাশে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট। স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ এর গ্রাউন্ড স্টেশন তৈরি করা হয়েছে গাজীপুর ও রাঙামাটির বেতবুনিয়ায়।
স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ এর সেকেন্ডারি গ্রাউন্ড স্টেশন দুইটির মধ্যে রাঙামাটির স্টেশন তৈরি করা হয়েছে রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার বেনবুনিয়ার ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রে। প্রকল্পের অবকাঠামো তৈরির কাজ করেছে ফরাসি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেসের নিয়োগকারী বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ‘স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড’। ২০১৬ সাল থেকে এই গ্রাউন্ডের কাজ শুরু হয়।
রাঙামাটি জেলার কাউখালী উপজেলার বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র দেশের প্রথম ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র। ৩০ জানুয়ারি ১৯৭০ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলার রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৪ জুন ১৯৭৫ সালে বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ উদ্বোধন করেন। বর্তমানে উক্ত কেন্দ্রের মাধ্যমে ১১টি দেশের সাথে টেলিফোন ডাটা কমিউনিকেশন, ফ্যাক্স, টেলেক্স ইত্যাদি আদান-প্রদান করা হয়। প্রায় ৩৫,৯০০ কি.মি. বা ২২,৩০০ মাইল উর্ধ্বাকাশে অবস্থিত কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে শক্তিশালী এন্টেনার দ্বারা বার্তা/তথ্য আদান-প্রদানের কাজ সম্পাদিত হয়।
রাঙামাটির, বেতবুনিয়া, সেকেন্ডারি গ্রাউন্ড স্টেশন প্রজেক্টের’র ব্যবস্থাপক শিপন হালদার বলেন, ‘২০১৬ সাল থেকে এই গ্রাউন্ডের কাজ শুরু হয়। এখন আমরা পুরোপুরি প্রস্তুত। প্রথম দিকে আমরা ১৭ জনের একটি টিম নিয়ে কাজ শুরু করি এখন বর্তমানে সব মিলিয়ে একশত জনের উপর লোকজন কাজ করছে এবং শেষ পর্যায়ে আছি আমরা।
রাঙামাটির, বেতবুনিয়া, সেকেন্ডারি গ্রাউন্ড স্টেশন প্রজেক্টের’র স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড’র কর্ডিনেটর মিজানুর রহমান বলেন, ‘বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রের পাঁচ একরজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে ‘বেতবুনিয়া বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন-২’। গাজীপুরে অবস্থিত স্টেশনের সঙ্গে বেতবুনিয়া স্টেশনের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। একই নকশায় গড়ে তোলা হয়েছে দুটি স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন। ডিম্বাকৃতির একটি ভবন ব্যবহার হবে মূল ভবন হিসেবে। এর ভেতরে আলাদাভাবে সাজানো হয়েছে স্যাটেলাইট অপারেশন, কন্ট্রোল সেন্টার ও নেটওয়ার্ক অপারেশন সেন্টার বিভাগ।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট লঞ্চিং প্রজেক্টের জুনিয়র কনসালটেন্ট প্রকৌশলী রায়হানুল কবির বলেন, ‘মূল ভবনের বাইরে বসানো হয়েছে বিশাল দুটি এন্টেনা। কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীদের জন্য রয়েছে ডরমেটরি ভবন। যেখানে ৩০ জনের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পেতে পাশেই তৈরি করা হয়েছে বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন (৩৩ কেভি)। এছাড়া নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সুবিধা পেতে বিটিসিএলের তত্ত্বাবধানে নিশ্চিত করা হচ্ছে নিখুঁত ফাইবার অপটিক সংযোগ। স্টেশন পরিচালনার জন্য ৩০ জনের একটি টিমকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেসের হাতে প্রশিক্ষিত বাংলাদেশি প্রকৌশলীরা কে, কোথায় দায়িত্ব পালন করবেন পরে তা সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে জানালেন বিটিআরসি’র এই কনসালটেন্ট।
স্থানীয় বাসিন্দা আরিফুর রহমান বলেন, ‘রাঙামাটির মানুষ হিসেবে এটি গর্বের একটি বিষয়। কারণ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট স্থাপনের কাজ বেতবুনিয়া হচ্ছে। এদিকে পাহাড়ি এই অঞ্চলে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট স্থাপনের ফলে দুর্গম অঞ্চলে টেলিযোগাযোগে আরো বেশি সুবিধা হবে মনে করছেন স্থানীয়রা।
বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের জন্য বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা। তবে খরচ হয়েছে ২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। এ অর্থের মধ্যে এক হাজার ৩১৫ কোটি টাকা বাংলাদেশের নিজস্ব তহবিল। এইচএসবিসি ব্যাংক বাকি এক হাজার ৬৫২ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে।
উৎক্ষেপণের পরে প্রায় সপ্তাহখানেক পর এই স্টেশনের কার্যক্রম শুরু হবে। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে গ্রাউন্ড স্টেশনে সিগন্যাল আদান-প্রদানে ১০ টন ওজনের দুটি এন্টেনা স্থাপন করা হয়। এন্টেনা দুটির একটি ২৬ কি-কিউ-ব্যান্ড এবং অন্যটি ১৪ সি-ব্যান্ড, যা স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রণে ট্রান্সপন্ডার হিসেবে কাজ করবে। এছাড়া বিদ্যুতের জন্য জেনারেটর স্থাপন ও বিদ্যুৎ সরবরাহে দুটি বিকল্প ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বর্তমানে চট্টগ্রামের হাটহাজারি থেকে সরাসরি বিদ্যুৎ সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে।