ঝুলন দত্ত ॥
দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ শষ্যভূমি, নানা প্রকার পশু পাখির অভায়ারণ্য, উঁচুনিচু বৈচিত্রময় পাহাড় আর নানা বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও জীবনধারায় পরিপূর্ণ রাইংখ্যং নদীর আশির্বাদপুষ্ট জনপদ রাঙামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ইউনিয়ন। প্রকৃতি যেন তাঁর আপন সুধারস মাধুরী দিয়ে সাজিয়েছে এই ইউনিয়নকে। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই সবুজের সমারোহ। বাংলাদেশের ‘নায়াগ্রা’ হিসেবে পরিচিত ধুপপানি ঝর্ণা এই ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডে অবস্থিত। যেখানে দেড়শত ফুট উপর হতে পানি আচড়ে পড়ে। বছরের সারা সময় পর্যটক আসে এই ঝর্ণার সৌন্দর্য উপভোগ করতে। এছাড়া রয়েছে অনন্য মন্দিরাছড়ার ঝর্ণা। মন্দিরাছড়ার উপরে ও নিচে রয়েছে বড়হাড় ও ছোটহাড় নামক জলধারা, যেখানে কয়েক কিলোমিটার ব্যপ্ত করে পাথরে আছড়ে পড়ছে স্বচ্ছ রাইংখ্যং স্রোতস্বীনির প্রবাহ। ফারুয়া ইউনিয়নের প্রতিটি পরতে পরতে লুকিয়ে আছে সৌন্দর্য। ১৬ হাজার জনসংখ্যার বসবাস এই ইউনিয়ন। তবে মোট জনসংখ্যার ৫০% অধিবাসী তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের হলেও এইখানে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, পাংখোয়া, বম ও বাঙালি জনগোষ্ঠী সম্প্রীতির সাথে সুদীর্ঘকাল যাবৎ বসবাস করে আসছে। এক কথায় একটি অসাম্প্রদায়িক জনপদ হিসাবে যুগের পর যুগ ধরে এই ইউনিয়নের জনগণ পরস্পরের সুখ-দুঃখ, হাসি কান্না বেদনায় সহমর্মী হয়ে বসবাস করে আসছে। এখানে ২০টি বৌদ্ধ বিহার, ৩টি মসজিদ, ৪টি গির্জা এবং একটি মন্দির রয়েছে। প্রত্যেকেই স্বাধীনভাবে তাদের ধর্ম পালন করে আসছে।
রাইংখ্যং নদীর দুই পাশে উপত্যকা তুল্য উর্বর ভূমিতে কৃষি এবং পাহাড়ে জুম চাষের ওপর এই এলাকার বাসিন্দাদের জীবন জীবিকা চলে। পার্বত্য চট্টগ্রামে কৃষি প্রধান এলাকা হিসাবে এই এলাকা বেশ সুপরিচিত। এখানকার উর্বর জমিতে বছরের সারাটা সময় ধরে নানা প্রকার ফসলের সমারোহ থাকে। সম্প্রতি রাজস্থলী উপজেলা হয়ে ভারত বর্ডার পর্যন্ত সীমান্ত সড়ক সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে নির্মিত হচ্ছে, সেটি ফারুয়া বাজারের পাশ দিয়ে বর্ডার অতিক্রম করবে।
আধুনিক সভ্যতার অনেক সুযোগ সুবিধা না পেলেও এলাকাবাসীর আন্তরিকতায় এখানে গড়ে উঠেছে একটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, যার নাম ফারুয়া উচ্চ বিদ্যালয়। মোবাইল, ইন্টারনেট, বিদ্যুৎ ইত্যাদি আধুনিক সভ্যতার অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত থেকেও শিক্ষক ও অভিভাবকদের আন্তরিকতায় গড়ে উঠা এই প্রতিষ্ঠানটির জেএসসি এবং এসএসসিতে ঈর্ষনীয় ফলাফল প্রমাণ করে এই প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল বাংলাদেশের সুযোগ সুবিধাসমূহ পেলে একদিন বিশ্ব জয় করবে। ফারুয়া উচ্চ বিদ্যালয় ছাড়াও এই ইউনিয়নের তক্তানালায় রয়েছে একটি জুনিয়র হাইস্কুল, তিনটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, জাতীয়করণকৃত ১২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এইছাড়া বেসরকারি কমিউনিটি পরিচালিত আরোও ৫টি বিদ্যালয় রয়েছে।
ফারুয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শান্তিময় তঞ্চঙ্গ্যা জানান, বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক এগিয়ে, সব কিছু এখন ডিজিটাল হয়ে গেছে। কিন্তু এইখানে নেটওয়ার্ক সুবিধা না থাকায় আমাদের শিক্ষার্থীরা অনেক কিছু হতে বঞ্চিত। তাই এই এলাকা দ্রুত ইন্টারনেটের আওতায় আসলে আমাদের শিক্ষার্থীরা এগিয়ে যাবে। এছাড়া ফারুয়া উচ্চ বিদ্যালয়টি যদি সরকারিভাবে আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয় করা হয় তাহলে দুর্গম প্রত্যন্ত অঞ্চলের গরীব শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করার আরো ভাল সুযোগ পাবে। তিনি আরো জানান, এই এলাকায় পাবলিক পরীক্ষা কেন্দ্র না থাকায় প্রতি বছর জেএসসি, এসএসসি পরীক্ষার্থীদের অনেক কষ্ট স্বীকার করে টাকা খরচ করে উপজেলা সদরে গিয়ে পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়।
এই ফারুয়া ইউনিয়নে শরওয়া, বরওয়া, মন্দিরাছড়া, তাংকুইতাং পাড়া, লতা পাহাড়, ছোট-বড় অনেক ঝর্ণা, সীমান্ত সংলগ্ন রোড, ঊদয়াচল সহ অনেক জনপদ সবাইকে মুগ্ধ করবে। যেখানে গেলে মনটা প্রশান্তিতে ভরে যাবে।
সম্প্রতি রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান এই ফারুয়া ইউনিয়ন পরিদর্শন করেন। এইসময় তিনি ফারুয়া উচ্চ বিদ্যালয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়, ফারুয়া ইউনিয়ন পরিষদ, ফারুয়া বাজার ঘুরে দেখেন এবং এখানকার জনপ্রতিনিধি, হেডম্যান, শিক্ষক এবং স্থানীয় জনগণের সাথে মতবিনিময় করেন এবং শীতবস্ত্র বিতরণ করেন। পরিদর্শনকালে রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, আমি প্রথমবারের মতো ফারুয়া ইউনিয়নে এসেছি। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য মুখে বর্ণনা করা যায় না, এক কথায় খুবই চমৎকার। অসীম সম্ভাবনার এই ফারুয়া ইউনিয়নে অনেক সমস্যা রয়েছে, যোগাযোগের সমস্যা রয়েছে, ইন্টারনেট সুবিধা নাই। আমি ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেছি, পত্রালাপ করেছি। আশা করছি অচিরেই ফারুয়া ইউনিয়ন ইন্টারনেটের আওতায় আসবে। তিনি আরোও বলেন, সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় সরকার এখানে সীমান্ত সড়ক করছে, যেটা ফারুয়া ইউনিয়নের ওপর দিয়ে যাবে, যার ফলে এখানকার জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটবে।
বিলাইছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীরোত্তম তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, ফারুয়া ইউনিয়ন একটি সম্ভাবনাময় ইউনিয়ন। বিশেষ করে কৃষি ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে আছে এই ইউনিয়ন। এখানে রাস্তাঘাট হলে জনগণ তাঁদের উৎপাদিত পণ্য সহজে বেচাবিক্রি করতে পারবে। এছাড়া এইখানে নেটওয়ার্ক সংযোগ আর বিদ্যুৎ সংযোগ দিলে জনগণ আধুনিক যুগের সাথে তাল মেলাতে পারবে।
৩নং ফারুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিদ্যালাল তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, ফারুয়া ইউনিয়ন একটি দুর্গম এলাকা। এইখানে পাহাড়ি-বাঙালি মিলে ১৬ হাজার মানুষের বসবাস। এখানে স্বাস্হ্যসেবা বৃদ্ধি, বিদুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক হলে ফারুয়া একটি বাংলাদেশের মডেল ও আধুনিক ইউনিয়নে উন্নিত হবে। তিনি আরোও জানান, মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে জন্ম মৃত্যু নিবন্ধনসহ ডিজিটাল বাংলাদেশের সেবাসমূহ যথাযথভাবে দেয়া যাচ্ছেনা। সরকারি সামজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী প্রকল্পসমুহ যেমন, বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধী ভাতা সহ শিক্ষা উপবৃত্তি টাকা ঠিকমত পাচ্ছে না সুফলভোগীরা।
বিলাইছড়ির উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মিজানুর রহমান বলেন, অনন্য সুন্দর ফারুয়া ইউনিয়নে পর্যটনের সকল প্রাকৃতিক ও নান্দনিক উপাদান রয়েছে। এখন প্রয়োজন অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও আধুনিক সুযোগ সুবিধা নিশ্চিতকরণ। ইতোমধ্যে রাইংখ্যং নদী খনন, সড়ক যোগাযোগ স্থাপন, নেটওয়ার্ক ও ইন্টানেটের আওতায় আনয়নসহ বেশকিছু কাজের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজম প্রতিষ্ঠার জন্যও এলাকাবাসীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। এলাকাবাসীর মাধ্যমেই এখানে কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজম প্রতিষ্ঠালাভ করবে। এই ফারুয়া তথা বিলাইছড়ি শীঘ্রই হবে বাংলাদেশের পর্যটনের প্রাণকেন্দ্র। কৃষি, প্রাণিসম্পদ ও পর্যটনের বিকাশের মাধ্যমে ফারুয়া হবে বাংলার সুইজারল্যান্ড।
রাঙামাটি সদর কিংবা কাপ্তাই উপজেলার জেটিঘাট হতে নৌ পথে ইঞ্জিন চালিত বোট বা স্পিড বোটে কাপ্তাই লেকের শুভ্র জলরাশির সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে বিলাইছড়ি উপজেলা পার হয়ে দীঘলছড়ি আর্মি ক্যাম্প, আলিখিয়ং, চাইন্দ্যা, উলুছড়ি, তক্তানালা, ওরাছড়ি, গোয়াইনছড়ি, ফারুয়া ইউনিয়ন পরিষদ পার হয়ে ফারুয়া মূল বাজার পৌঁছাতে হয়। পথেমধ্যে সবুজ ক্ষেত, রাইংক্ষং নদীর দুই ধারে ছোট বড় পাহাড়, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় জীবনধারা উপভোগ করতে যে কেউ হারিয়ে যাবে কল্পনার রাজ্যে।
এক কথায় পর্যটনের ক্ষেত্রে অপার সম্ভাবনার একটি ইউনিয়ন ফারুয়া ইউনিয়ন। শুধুমাত্র সরকারি বেসরকারি উদ্যোগই পারে এই এলাকাকে একটি পর্যটন বান্ধব উন্নত এলাকা হিসাবে গড়ে তুলতে।