প্রাণচঞ্চল সমতাঘাট এখন প্রাণহীন


কভিড-১৯’র প্রভাব পড়েছে রাঙামাটি সব থেকে বড় পাইকারী বাজারে। যে বাজার ক্রেতা বিক্রেতার জট লেগে থাকত সারাদিন, সেই এলাকা এখন অনেকটাই জনমানব শূণ্য। ৩১ মার্চ মঙ্গবার সকাল ও বিকালে বনরূপা সমতাঘাট বাজার গিয়ে দেখা যায় সুনসান নিরবতা। রাঙামাটির সব থেকে বড় বাজার, যেখানে প্রতিদিন কলা, আনারস, তরমুজসহ বিভিন্ন কাঁচা পণ্য নিয়ে আসে পাহাড়ি মানুষ। গড়ে প্রায় ২/৩ শ বোট ভেড়ানো থাকে ঘাটে। ক্রেতা বিক্রেতার দরকষাকষি আর হাক ডাকে মূখর বাজারটি যেন মৃত। হাতে গোনা ৮/১০টি বোট ভিড়লেও নেই তাতেও নেই কোন পণ্য। নেহাতই নিজেদের প্রয়োজনীয় কেনাটাকা করতে এসেছেন তারা।
তাদের মধ্যেই একজন রিপন চাকমা। তিনি জানান, আমি আসলে বাজারের অবস্থা দেখতে এসেছি, মানুষ আছে কিনা, বা ব্যাপারী আছে কিনা। আমার বাগানে প্রচুর আনারস আধা পাকা হয়ে আছে, দুয়েক দিনের মধ্য বেঁচতে না পারলে সব বাগানেই নষ্ট হয়ে যাবে। আমার মাথা কাজ করছে না। কি করবো ঠিক বুঝতে পারছিনা।
তিনি আরও বলেন, করোনা প্রভাবের আগে এক বোট আনারস এনেছিলাম বেশ ভাল দামে বিক্রয় হয়েছিল। তাই বেশি লাভের আশায় আমার পাশের আনারস বাগানটাও আগাম কিনে নিয়েছিলাম। এখন মনে হচ্ছে নিজেরটা নষ্ট হলেও ক্ষতি কাটিয়ে ওঠতে পারতাম, কিন্তু নগদ টাকায় কেনা বাগানে লস কিভাবে কাটিয়ে ওঠবো সেটা ভাবতেও পারছিনা।
একই রকম আরেক ব্যবসায়ি সমির চাকমা বলেন, আমার বাগানে কম করে হলেও ৩ লাখ আনারস আছে, বড় জোড় আর এক সপ্তাহ রাখা যাবে, এরপর সেগুলো বাগানে পঁচবে। বাজারে এনে কি করবো, ব্যাপারি নাই, কিনবে কে? ২০ টাকার আনারস বলে ৫ টাকা, তার চেয়ে ক্ষেতেই পঁচে যাক, অন্তত সার হবে। তিনি বলেন, এই দামে বেঁচলে বাগানে আনারস কাটা শ্রমিক ও বোট ভাড়াও হবে না, ঘর থেকে টাকা এনে তাদের দিতে হবে। তার থেকে বাগানেই থাক। ’

আনারস ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম জানান, ৪টি বাগান কিনেছি, এর মধ্যে প্রায় দু লাখ আনারস নিয়ে যেতে পেরেছি, আরো প্রায় ৬ লাখ আনারস এখনো বাগানেই আছে। কিন্তু তিনি সেগুলো আনতে সাহস পাচ্ছিনা, শহরের সকল আড়ত বন্ধ রয়েছে, নিয়ে গিয়ে বেঁচবো কার কাছে। এই ভরা মৌসুমে বিশাল ক্ষতি হয়ে গেল। সহসা অবস্থার পরিবর্তন না হলে আমার পুঁজিও হারিয়ে ফেলবো।
আব্দুল সাত্তার এক বোট তরমুজ নিয়ে ঘাটে অপেক্ষা করছেন, ক্রেতা নেই, বাধ্য হয়ে খুচরা বিক্রয় করছেন। তিনি বলেন, ক্ষেত ভরা তরমুজ, অনেক আশা নিয়ে চাষ করেছিলাম, ফলনও ভাল হয়েছে, কিন্তু বেঁচতে পারছিনা। এখন ভয়ে আছি যদি শিলাবৃষ্টি হয় তাহলে একদম পথে বসে যাব।
শ্রমিক সালাম মিয়ার তথ্য মতে সমতাঘাটে ফল ওঠা নামার কাজ করে প্রায় ৪শ শ্রমিক। এটা ছিল তাদের ভরা মৌসুম, এ মৌসুমে কাজ করে সারা বছর চলার মত টাকা আয় করে থাকেন তারা। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে বাজারে আসছেনা কোন পণ্য, ফলে তাদের আয় বন্ধ হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, আগে আমরা প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার টাকা আয় করতাম, এখন সব বন্ধ হয়ে গেছে। জমানো টাকা খরচ করে চলছি, জানিনা আর কত দিন চলতে পারব।
আরেক শ্রমিক আবুল হোসেন বলেন, এখন তো আপনার সাথে কথা বলার সময় থাকার কথা ছিলনা, কাজ করতেই জান বাহির হয়ে যাবার কথা ছিল। কিন্তু এখন হাত গুটিয়ে বসে আছি। একটা বোট আসল, সবাই মিলে মাল নামাই, যা পাই তা সবাই ভাগ করে নিই। কি আর করা, চলতে তো হবে।
এখন পর্যন্ত পাহাড়ে করোনা ভাইরাসে কেউ আক্রান্ত না হলেও মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে পাহাড়ের কৃষি নির্ভর অর্থনীতি। এই সংকট কবে নিরস হবে অথবা আদৌ হবে কিনা জানেনা কেউই। বিশ্ব অর্থনীতির অনিশ্চিত যাত্রার মতো অচেনা পথে যাত্রা শুরু হয়েছে পার্বত্য অর্থনীতিরও………