জিয়াউল জিয়া ॥
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনগোষ্ঠীর পুষ্টির প্রতিশ্রুতি উন্নয়ন শীর্ষক গোল টেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে রাঙামাটিতে। বৃহস্পতিবার সকাল শহরের পর্যটন সম্মেলন কক্ষে পুষ্টি সমন্বয় কমিটি, লিডারশীপ টু এনসিওর এডকুয়েট নিউট্রিশন (লীন) এবং দি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এর উদ্যোগে আয়োজিত সভা দুপুর পর্যন্ত চলে।
রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের সভাপতিত্বে অতিথি ছিলেন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অংসুইপ্রু চৌধূরী, সিভিল সার্জন বিপাশ খীসা, চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়, রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড. কাঞ্চন চাকমা, জাতীয় পুষ্টি পরিষদের উপ-পরিচালক ডা. নুসরাত জাহানসহ জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাবৃন্দ।
আলোচনা সভায় বক্তরা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে সচেতনতার পাশাপাশি তাদের পুষ্টিহীনতার দূর করতে কার্যকরি পদক্ষেপ নিতে হবে। পাহাড়ের প্রান্তিক মানুষের জন্য পুষ্টিকর খাদ্য যোগাড় ও পুষ্টিহীনতা দূর করতে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। পাহাড়ে পুষ্টির সকল উপাদান থাকার পরও শুধুমাত্র খাদ্যাভ্যাসের কারণে এই অঞ্চলের মানুষ পুষ্টি সূচকে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে। খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারলেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠির পুষ্টিহীনতার দূর করা সম্ভব।
এই অঞ্চলের মা ও শিশুদের পুষ্টির প্রতিশ্রুতি উন্নয়নে পুষ্টির সুশাসন, আচরণগত পরিবর্তন নিশ্চিত করা এবং মূল্য চেইনের জন্য শক্তিশালী জোট গঠন জরুরি। পুষ্টির পরিসেবার মানোন্নয়নে প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় এবং জবাবদিহিতা দরকার।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বরুণ দত্ত বলেন, পার্বত্য এলাকায় পুষ্টি সমৃদ্ধ উপদানের কোন ঘাটতি নেই কিন্তু এর ব্যবহার নিয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠির মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করা গেলেই আমরা আমদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিয়ে কাজ করতে হবে। পার্বত্য এলাকায় পুষ্টি নানা উপাদান আছে শুধু এটির সঠিক ব্যবহার দরকার। শুধু নিয়মিত ডিম ও দুধ পান করলে আমরা ৯০ ভাগ পুষ্টি পূরণ করা সম্ভব। ২০১৮ সাল থেকে আমরা কাজ করলেও এই বিষয়ে তেমন কোন অগ্রগতি হচ্ছে বলে আমার মনে হয় না।
কৃষি বিভাগের উপ-পরিচালক অপ্রু মারমা বলেন, ফল উৎপাদনে রাঙামাটি এখন অনেক এগিয়েছে তবে সবজি উৎপাদনে ১০টি উপজেলার মধ্যে লংগদু ছাড়া বাকীগুলোতে সেভাবে উৎপাদন হচ্ছে না। পাহাড়ি এলাকায় জুম চাষে ধান ছাড়া সবজির উৎপাদন ভালো তবে এই বিষয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। কিভাবে এর উৎপাদন আরও বৃদ্ধি করা যায়। আমরা পারিবারিক পুষ্টি বাগান সৃজনে জোর দিচ্ছি।
জেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম বলেন, জেলার দুর্গম এলাকা ছাড়া বাকি স্কুলগুলোতে পুষ্টি বিষয়ে প্রতিমাসে অভিভাবক সভার মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ চলছে। তবে দুর্গম এলাকার মধ্যে সাজেকে ২২টি স্কুল রয়েছে সেখানে স্বাস্থ্য সেবা ও সেনিটশন সুবিধাসহ নানা অসুবিধা রয়েছে। আমরা বিদ্যালয়ের আগত শিশুদের আলাদা যতœ নিতে শিক্ষকদের বলা হয়েছে। পাড়াকেন্দ্রের প্রশংসা করে তিনি আরও বলেন, এর ফলে স্কুলে ভর্তির আগেই শিশুদের বাড়তি যতœ পায় শিশুরা। এই পাড়াকেন্দ্রগুলোকে কিভাবে আরও কাজে লাগানো যায় সেই বিষয়ে নজর দেওয়া দরকার।
কাউখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার নাজমুন আরা সুলতানা বলেন, এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্প পাহাড়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে আমরা সেটি ভালোভাবে জানি না। এখন শেষ পর্যায়ে এসে শুনছি। তিনি আরও বলেন, এখানকার স্থানীয়রা বাচ্চাকে পেট ভরে খাওয়াকেই পুষ্টি বুঝে। খুবই অসচেতন পাহাড়ের সাধারণ মানুষ। সামাজিক কুসংস্কারের কারণে পুষ্টি সম্পর্কে তারা তেমন কিছুই জানেন না। এই অবস্থার পরিবর্তনে সকলে মিলে কাজ করতে হবে।
চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বলেন, কোন খাদ্য কিভাবে খেতে হবে সেটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে জানাতে হবে। হঠাৎ খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন সম্ভব না। পাহাড়ি জনগোষ্ঠী তেল ছাড়া শাক খেয়ে থাকে। কিন্তু সব তেলে পুষ্টিগুণ আছে। সেই বিষয়টি বুঝাতে হবে। এখানে কোন কিছু বাস্তবায়ন করতে হলে অবশ্যই দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অংসুই প্রু চৌধুরী বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নয়ন সমৃদ্ধিশালী দেশ গড়ে তুলতে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। তিনি আরও বলেন, মারমা জনগোষ্ঠীদের মধ্যে বাসায় মেহমান না আসলে মুরগীর মাংস খেত না। আবার মুরগী পালন করে বাচ্চা ফুটানোর জন্য খাওয়ার জন্য না। কাপ্তাই লেকের আশপাশের লোকজন ছাড়া এই লেকের মাছ একটি বড় অংশ খেতে পায় না। আবার যেসব এলাকায় বিদ্যুৎ নাই সেসব এলাকায় পোল্ট্রি ফার্ম করতে পারছে না। দুর্গমতার, সচেতনতা ও অর্থনৈতিকতার অভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠি পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। এর জন্য স্বল্প মেয়াদী ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি।
রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, পাহাড়ের শিক্ষিত মানুষকে বেশি সচেতন করতে হবে। আমরা এগিয়ে যেতে চাই। আমরা আমাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে হবে। যে যার অবস্থা থেকে আন্তরিকতার সাথে চেষ্টা করলে পাহাড়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠি পুষ্ঠিহীনতায় থাকবে না।
পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় মা ও শিশুর পুষ্টি উন্নয়নে কাজ করছে লিডারশীপ টু এনসিওর এডকুয়েট নিউট্রিশন (লীন)। মূলত: প্রান্তিক ও পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠির শিশু, কিশোর, গর্ভবতী, ও দুগ্ধদানকারী মা‘দের পুষ্টিহীনতা দূর করতে ২০১৮ সাল থেকে এই বিশেষ কার্যক্রম শুরু হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের ১৮ উপজেলার ৭৮টি ইউনিয়নে কাজটি চলছে। চলবে আগামী বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।