পাহাড় ধস ও পরবর্তি শঙ্কা

হ্রদ পাহাড় ঘেরা আমাদের প্রাণের শহর রাঙামাটি, সবুজ পাহাড় আর স্বচ্ছ জল চোখ জুড়িয়ে দেয়। সেই রাঙামাটি আজ যেন বিবর্ণ, প্রকৃতির বিরুপ আচরনে এই প্রিয় জেলা মৃত্যুপূরিতে পরিনত হয়েছে। প্রবল বর্ষণ আর পাহাড় ধসে দীর্ঘ হয়েছে লাশের মিছিল। প্রকৃতির এমন বিরুপ আচরন আগে কেউ দেখেনি, বা ভুলেও ভাবেনি এমনটা হতে পারে, কিন্তু হয়েছে এটাই সত্যি।
ক্ষয়ক্ষতি বলতে বেশ কিছু বাড়িঘর ধসে গেছে, পাহাড় ধসেছে কম বেশি ১৪৫ টার মত, সড়ক বিচ্ছিন্ন হয়েছিল , আরো কিছু প্রাথমিক বিপর্যয়, আর্থিক ক্ষতি নিরুপনে কাজ চলছে, তবে প্রাথমিকভাবে সড়ক বিভাগের দাবি, তাদের ক্ষতি আনুমানিক ১৫০ কোটি টাকা, বা নগরপিতার দাবি শুধু পৌরসভার অবকাঠামোগত ক্ষতির পরিমান প্রায় দুইশত কোটি টাকা। তাদের যার যার অবস্থান থেকে এটা হয়তো সঠিক, তবে এখানে এটা আলোচ্য বিষয়ও নয়। এ মহাবিপর্যয়ের ক্ষতি এভাবেই নিরুপন করা হয়।
যদি একটু ভিন্ন চোখে দেখি তবে এই ক্ষতি ভয়ংকর রুপ নিবে এবং এটাই সত্য। গত ১২ জুন রাতের প্রবল বষর্ণ আর পাহাড় ধসে আমাদের যে ক্ষতি হয়েছে এর মধ্যে যেগুলো আমাদের মাঝে দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব ফেলবে সেগুলোকে নিন্মরূপ হতে পারে, (১) কৃষি ক্ষেত্র (২) হ্রদ (৩) মৎস্য (৪) যোগাযোগ, আরো অনেক বিষয় আছে সেগুলো এখানে যুথবদ্ধ নাইবা করলাম।
১) কৃষি ক্ষেত্রে প্রভাবঃ আমাদের এই পার্বত্য জেলাতে প্রকৃতিগত ভাবেই চাষ যোগ্য জমির পরিমাণ একেবারেই কম। পাহাড় ধসের কারণে আমাদের চাষে জমিতে যে পরিমান বালু পড়েছে তাতে ঐ জমি আগামি কত বছরে সঠিক উৎপাদনে যেতে পারবে তা আলোচনার দাবি রাখে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে অধিকাংশ জমি পাথর বালুতে চাপা পড়েছে, কোথাও কোথাও এই পাথর বালুর আস্তরণ দেড় থেকে দু’ফুট ছাড়িয়ে গেছে, সে কারণেই এ জমি এবার চাষ করা সম্ভবনা, যদিও করা হয় তবে তেমন ফলন পাবেনা কৃষক। অপরদিকে আগাম বৃষ্টি হওয়াতে হ্রদে ভাসা জমির ফসল ঘরে তুলতে পারেনি কৃষক। সুতরাং এর ফলাফলটা কি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
২) হ্রদঃ এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই আমাদের জীবন জীবিকার প্রায় ৫০ থেকে ৬০ ভাগ কাপ্তাই হ্রদ নির্ভর হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় সৃষ্টির পর হতে এ হ্রদের শ্বাসনালি বা হ্রদে প্লাবিত নদী ড্রেজিং করা হয়নি, যে কারণে নদীগুলো এখন মৃত প্রায়, যে কারণে এ হ্রদ দিন দিন নাব্যতা হারাচ্ছে। ব্যহত হচ্ছে হ্রদ সৃষ্টির প্রধান দুই উদ্দেশ্য, বিদ্যুৎ ও মৎস্য উৎপাদন। প্রতি বছর কাপ্তাই হ্রদের তলদেশে এক থেকে দেড় ফুট পলি জমে, আর এবারের বিষয়টি আরও ভায়াবহ, প্রবল বর্ষণে যে পরিমান পাহাড় ধস হয়েছে , সে মাটির পরিমান লক্ষ কোটি টনে অনুমান করাটাও কঠিন হয়ে যাবে, যা এসে জমা হয়েছে এই হ্রদের তলদেশে। এবার হিসাব নিকাশে বসা যাক, প্রতি বছরেওে গড় পলি মাটি এক দেড় ফুটের সাথে এবারের পাহাড় ধসের বাড়তি মাটি কম করে ধরে নেয়া যাক দেড় দুই ফুট, সরল ভাবে ধওে নিলেও তিন থেকে সাড়ে তিন ফুট মাটি জমা হয়েছে হ্রদের তলায়। একবার ভাববেন কি এর ফলাফলটা কি হতে পারে?
৩) মৎস্যঃ ৭২৫ বর্গ কিলোমিটা আয়তনের এই হ্রদকে ঘিরেই এ জেলার মানুষের জীবন জীবিকা, এ হ্রদে মাছ শিকার করে জীবন নির্বাহ করে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার জেলে। ধরে নেয়া যায় মাছের উপর নির্ভর করে প্রায় ৩০ হাজার পরিবার। গড়ে পরিবার প্রতি ৪ জন করে হিসাব করলেও প্রায় এক লক্ষ ২০ হাজার মানুষ। আর আশার কথা হলো প্রায় দেড় দশক পরে কাপ্তাই হ্রদে কার্প জাতীয় মাছ প্রাকৃতিক ভাবে প্রজনন করেছে, সে ডিম সংগ্রহ করে মৎস্য গবেষণা ইনিস্টিটিউট পর্যবেক্ষন করে এবং ডিম থেকে পোনা উৎপাদন হয়েছে। সুতরাং বলতেই পারি অবমুক্ত করা পোনার সাথে যুক্ত হবে হ্রদে প্রাকৃতিক ভাবে জন্ম নেয়া পোনাও। কিন্তু বিধি বাম হয়ে দাঁড়ালো পাহাড়ের বালু মাটি, এ বালু হ্রদের তলের মাছের খাদ্য শৃঙ্খলা নষ্ট করবে, মাছের স্বাভাবিক উৎপাদন ব্যহত হবে। মাছ যদি কম আহরিত হয় তবে কি ঘটতে পারে ??
৪) যোগাযোগঃ সড়কের যে বেহাল দশা হয়েছে আশা করতেই পারি সহসাই ছোট খাটো ছাড়া বড় প্রতিবন্ধকতা গুলো কাটিয়ে উঠতে পারবো। কিন্তু আমাদের জেলা শহরের সাথে ৬টি উপজেলার যোগাযোগ নৌপথে। তবে লংগদু, নানিয়ারচর ও বাঘাইছড়ি সাথে কিছুটা সড়ক যোগাযোগও আছে, বাকি ৩টি সম্পূর্ণ নৌ যোগাযোগ, আগেই উল্লেখ করা হয়েছে হ্রদের তলদেশে এবার প্রায় আড়াই থেকে তিনফুট পলি ও মাটি জমবে। গত শুষ্ক মৌসুতে দেখা গেছে লংগদু, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়িতে ৪/৫ ফুট পানিতে অনেক কষ্ট করে নৌযান চলাচল করেছে। আগামী শুষ্ক মৌসুমে কি হতে পারে সেটা ভেবে দেখবেন কি???
আমরা যদি মনে করে থাকি মহাবিপর্যযটা আমরা অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে মোকাবেলা করেছি, এত সহজে কাজটা কিভাবে করলাম, এমন আতœপ্রত্যয়ি হয়ে তৃপ্তরি ঢেকুড় তোলার কিছু নেই।
উপরোক্ত আলোচনা হতে যে সকল অশুভ লক্ষন আমাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে , এখান থেকে পরিত্রানের জন্য স্থানীয় প্রশাসন, আঞ্চলিক প্রশাসন, সর্বপরি সরকারকে কমপক্ষে ২ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহন করতে হবে, অন্যথায় পুরো রাঙামাটি জেলাই সাজেকে রুপান্তর হতে পারে।
বলার আছে বলবোনা।