ভেজা চোখে এদিক ওদিক তাকায় মীম। সাতবছর বয়সী মীম আর সতের মাস বয়সী তার ছোটবোন সুমাইয়া মা আর বাবাকে দেখেনা কোথাও। তবুও আশা,বাবা এবং মা ফিরবেন, কিনে দিবেন ঈদের নতুন জামাকাপড়। কিন্তু বাস্তবতা যে বড়ই কঠিন আর নির্মম। হত ১৩ জুন রাঙামাটি শহরের রূপনগর এলাকায় পাহাড়ধসে বাবা সালাউদ্দিন আর মা রাহিমা বেগম এর মৃত্যুর পর স্বজনদের কোলেই ঠাঁই এখন এই দুই শিশুর। সামনে ঈদ,বাবা মা কে ছাড়া কেমনই কাটতে পারে এই দুই অবুঝ শিশুর ঈদ,তা সহজেই অনুমেয়।
শুধু সুমাইয়া বা মীম’ই নয়। ভয়ংকর পাহাড় ধসে এমন স্বজন হারানো অসংখ্য মানুষের এবারের ঈদ কাটবে আশ্রয়কেন্দ্রেই। শহরের ১৯ টি আশ্রয়কেন্দ্রের সবগুলোর চিত্রই প্রায় একই রকম। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়েই ঈদ উদযাপন করবে এসব দুর্গত মানুষেরা।
সরেজমিনে রাঙামাটির আশ্রয়কেন্দ্রগুলো পরিদর্শন করে দেখা গেছে, সেখানে দুই ধরণের মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। এদের মধ্যে রয়েছে পাহাড়ধসে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত এবং নিহতদের পরিবারের মানুষ, সম্ভাব্য ক্ষতির শংকায় আশ্রয় নেয়া মানুষ । যাদের বাড়ীঘরের তেমন একটা ক্ষতি হয়নি,তারা অনেকেই দিনের বেলায় নিজ নিজ বাসায় ফিরে গিয়ে বসত মেরামতের কাজ করে ধীরে ধীরে সব গুছিয়ে আনছেন। কিন্তু যারা বসত ও স্বজন হারিয়েছেন, তাদের মুক্তি মিলছেনা এতো সহজেই। কবে ফিরবেন বাড়ি কিংবা আদৌ পুরনো ঠিকানায় ফেরা হবে কিনা, এনিয়ে বিস্তর সংশয়। কারো কারো তো জীবনই আবার শুরু করতে হবে নতুনভাবে।
রাঙামাটি সরকারি কলেজ আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নেয়া কাউসার বলেন, ভাই ও ভাবি মারা গেছেন, তাদের দুই এতিম সন্তানকে সাথে নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রেই পালন করবো ঈদ। ঈদের নামাজটাই পড়া হবে হয়তো,কিন্তু অন্য কিছু করা কি সম্ভব ? কিছুই জানিনা।
তবে আশার কথা শোনালেন রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মানজারুল মান্নান। তিনি বলেন, ঈদের আনন্দ থেকে এরা কেউই বঞ্চিত হবেনা। আমরা সবাই এবার ঈদ পালন করবো আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা এসব মানুষের সাথে। এটাতো ঠিক,নিজ বাড়ীতে থেকে ঈদের যে আনন্দ তারা উপভোগ করতো,সেটা আশ্রয়কেন্দ্রে সম্ভব না,তবে আমরা চেষ্টা করবো,তাদের পাশে থেকে ঈদের আনন্দটা ভাগাভাগি করতে। ঈদের দিন প্রতিটি কেন্দ্রেই সেমাই সহ সুস্বাদু খাবার ব্যবস্থা করা হবে বলেও জানান তিনি।
শুধু জেলা প্রশাসনই নয়,রাঙামাটি রেডক্রিস্টে এর তরুণ সদস্যরাও এবার তাদের তত্ত্বাবধানে থাকা চারটি আশ্রয়কেন্দ্রের শিশুদের সাথে ঈদ কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যুব রেডক্রিসেন্ট এর দলনেতা সাইফুলউদ্দীন জানিয়েছেন, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবার আমরা ঈদ কাটাবো আমাদের দায়িত্বে থাকা চারটি আশ্রয়কেন্দ্রের মানুষগুলোর সাথে। তাদেরকে প্রকৃত আনন্দ হয়তো দিতে পারবনা,কিন্তু পাশে থেকে,সাথে থেকে চেষ্টা করবো কিছুটা হলেও আনন্দে রাখতে।
এদিকে রাঙামাটির পাহাড়ধসের ঘটনায় রাঙামাটির ঈদ বাজার দৃশ্যত ধ্বংস হয়ে গেছে। এই শোকে বিহ্বল পুরো শহরের কোথাও নেই ঈদের কেনাকাটার ন্যুনতম উচ্ছাস। শহরের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বাজার তবলছড়ি,বনরূপা এবং রিজার্ভবাজারের একটি মার্কেটেও গিয়ে দেখা মিললো না কোন ক্রেতা। হতাশ বিক্রেতারা রোজার শুরুতেই যে বিনিয়োগ করেছেন,তা জলে যাওয়া বিপাকে পড়েছেন।
বৃহত্তর বনরূপা ব্যবসায়ি কল্যান সমিতির সভাপতি আবু সৈয়দ বলেন, একদিকে পাহাড় ধসে ১২০ জনের মৃত্যু আর অন্যদিকে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়াসহ নানান সংকটে ব্যবসা বাণিজ্যে যে বিশাল ধস নেমেছে তা আগামী তিনমাসেও স্বাভাবিক হবে কিনা সন্দেহ। ঈদের বাজারতো একেবারে মাটিই হয়ে গেছে। তিনি আশা করছেন, শেষে দুচারদিন হয়তো কিছু কেনাকাটা হলেও করবেন রাঙামাটির মানুষ।
তবে সব মিলিয়ে রাঙামাটির ঈদ বাজার আর ঈদ আনন্দ যে মোটামুটি মাটিই হয়ে গেছে,পাহাড় ধসে, এটা নিশ্চিত বলাই যায়।