১৯৯৭ সালে সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে পার্বত্য চুক্তির পর চুক্তির বিরোধীতা করে জন্ম নেয়া ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ)। সেই থেকে দুই দলের বিরোধে ২০১৬ পর্যন্ত সশস্ত্র সংঘাতে মারা গেছে প্রায় এক হাজার নেতাকর্মী। কিন্তু ২০১৬ সালে দুই দলের মধ্যে অলিখিত ও অপ্রকাশ্য এক চুক্তির ফলে দুই দলের মধ্যে সশস্ত্র সংঘাত বন্ধ আছে। ফলে স্বস্তির নি:শ^াস নেমে আসে পাহাড়ে। তবে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিশবছর পূর্তি উপলক্ষ্যে রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা সন্তু চুক্তি বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতার অভিযোগ এনে ‘পাহাড়ে আবার আগুন জ¦লবে’ বলে হুঁশিয়ারি দেন।
কাকতালীয়ভাবে তার এই ঘোষণার মাত্র দুইদিন পরেই ৫ ডিসেম্বর অনাধি রঞ্জন চাকমা (৫৫) নামের এক ইউপিডিএফ সমর্থক ইউপি সদস্যকে হত্যা করা হয়। এই হত্যার জন্য ইউপিডিএফ (গনতান্ত্রিক) কে দায়ি করে ইউপিডিএফ। ওইদিন সকাল পৌনে ১০টার দিকে অনাধিকে নানিয়ারচর সতেরোমাইল ও আঠারোমাইলের মধ্যবর্তী চিরঞ্জীব দোজরপাড়া এলাকার নিজ বাসা থেকে ডেকে বের করে গুলি করে হত্যা করা হয়।
একই দিন রাঙামাটির জুরাছড়িতে উপজেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অরবিন্দ চাকমাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আওয়ামীলীগ এই হত্যাকান্ডের জন্য সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতিকে দায়ি করে। একই দিন বিলাইছড়ি উপজেলা আওয়ামীলীগের সহসভাপতি রাসেল মার্মাকে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করা হয়। একদিন পরেই ৭ ডিসেম্বর রাঙামাটি শহরে জেলা মহিলা আওয়ামীলীগের সহসভানেত্রী ঝর্ণা খীসার বাসায় হামলা করে তাকে হত্যা করতে কূপিয়ে মারাত্মক জখম করা হলেও প্রাণে বেঁচে যান তিনি। বিলাইছড়ির ঘটনায় সেখানকার উপজেলা চেয়ারম্যান ও জনসংহতি সমিতির নেতা শুভমঙ্গল চাকমাসহ কয়েকজনকে আটকও করা হয়। পরে তারা জামিনে মুক্তি পান।
১৬ ডিসেম্বর রাঙামাটি সদর উপজেলার বন্দুকভাঙ্গায় ইউপিডিএফ কর্মী ও সংগঠক অনল বিকাশ চাকমাকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। ইউপিডিএফ এই হত্যাকান্ডের জন্য নতুন ইউপিডিএফকে দায়ি করে।
৩ জানুয়ারি বিলাইছড়ি উপজেলায় যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিশ^রায় তংচঙ্গ্যাকে গুলি করা হলেও তিনি প্রাণে বেঁচে যান। এই ঘটনার জন্য যুবলীগ জনসংহতি সমিতিকে দায়ি করেছিলো।
৩ জানুয়ারি খাগড়াছড়িতে গুলি করে হত্যা করা হয় ইউপিডিএফ এর অন্যতম নেতা মিঠুন চাকমা। ইউপিডিএফ এই হত্যার জন্য ইউপিডিএফ-গনতান্ত্রিককে দায়ি করেছে।
৩০ জানুয়ারি আওয়ামীলীগের সন্ত্রাসবিরোধী মহাসমাবেশে অংশ নেয়ায় বিলাইছড়িতে আওয়ামীলীগের তিন কর্মীকে কূপিয়ে মারাত্মক জখম করা হয়। এই ঘটনার জন্য সন্তু লারমার জনসংহতি সমিতিকে দায়ি করেছিলো আওয়ামীলীগ। ১২ ফেব্রুয়ারি রাঙামাটি শহরে ছাত্রলীগ নেতা সুপায়ন চাকমাকে মারধর করে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ কর্মীরা,প্রতিবাদে রাঙামাটিতে হরতাল পালন করে ছাত্রলীগ।
২১ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় সুভাষ চাকমা নামের একজন গুলি করে হত্যা করা হয়। সেইও ইউপিডিএফ কর্মী ছিলো।
১৭ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি শহরের হরিনাথপাড়া এলাকায় ইউপিডিএফ কর্মী দীলিপ কুমার চাকমাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনি ইউপিডিএফের হরিনাথ পাড়ার সাংগঠনিক দায়িত্বে ছিলেন। তিনি পানছড়ির চেঙ্গী ইউনিয়নের মনিপুর এলাকার সন্তোষ কুমার চাকমার ছেলে।
১১ মার্চ বাঘাইছড়িতে গুলি করে হত্যা করা হয় ইউপিডিএফ কর্মী নতুন মনি চাকমাকে। ওইদিন রাতে নিজ বাড়িতে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে নতুন মনি চাকমাকে হত্যা করা হয়। তাঁর মাথাসহ সারা শরীরে কোপানো হয়। তিনি ইউপিডিএফের প্রসীত বিকাশ খীসা পক্ষের কর্মী ছিলেন।
১৮ মার্চ রাঙামাটির কুতুছড়ি থেকে অপহরণ করা হয় ইউপিডিএফ সমর্থিত হিল উইমেন্স ফেডারেশন নেত্রী মন্টি চাকমা ও দয়াসোনা চাকমাকে। ৩২ দিন পর ১৯ এপ্রিল মুক্তি দেয়া হয় তাদের। এই ঘটনার জন্য ইউপিডিএফ-গনতান্ত্রিককে দায়ি করে ইউপিডিএফ।
১২ এপ্রিল পাল্টাপাল্টি হামলায় মারা যায় ৩ জন। রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলায় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) এক সদস্যকে গুলি করে হত্যার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিরও (এমএন লারমা) দুই কর্মীকে হত্যা করা হয়। নিহতরা হলেন ইউপিডিএফ কর্মী জনি তঞ্চঙ্গ্যা (৪০), জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) কর্মী পঞ্চায়ন চাকমা ওরফে সাধন চাকমা (৩০) ও কালোময় চাকমা (২৯)।
১৬ এপ্রিল খাগড়াছড়ি শহরের পেরাছড়া এলাকায় সন্ত্রাসী হামলায় সূর্য বিকাশ চাকমা নামে একজন নিহত হয়। তিনিও ইউপিডিএফ এর দুই অংশের বিরোধের কারণে মারা গেছেন বলে ধারণা করা হয়।
২২ এপ্রিল খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলার মরাটিলা এলাকায় ইউপিডিএফ ও জনসংহতি সমিতির (এম এন লারমা) মধ্যে গোলাগুলির ঘটনায় সুনীল বিকাশ ত্রিপুরা (৪০) নামের এক ইউপিডিএফ নেতা নিহত হন।
৩ মে নানিয়ারচর উপজেলায় নিজ কার্যালয়ে সামনের সময় গুলি করে হত্যা করা হয় উপজেলা চেয়ারম্যান ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি(এমএনলারমা)’র অন্যতম শীর্ষ নেতা শক্তিমান চাকমাকে। এইসময় তার সাথে থাকা সংগঠনটির আরেক নেতা রূপম চাকমা গুলিবিদ্ধ হয়।
এর একদিন পরেই ৪ মে শক্তিমান চাকমার দাহক্রিয়ায় অংশ নিতে যাওয়ার পথে সশস্ত্র হামলায় নিহত হন ইউপিডিএফ-গনতান্ত্রিক এর শীর্ষ নেতা তপন জ্যোতি চাকমা বর্মা,পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি(এমএনলারমা)’র নেতা সুজন চাকমা,সেতুলাল চাকমা,টনক চাকমা এবং গাড়ী চালক সজীব। এসময় আহত হন আরো ৮ জন।
রাঙামাটির পুলিশ সুপার আলমগীর কবির জানিয়েছেন, আঞ্চলিক দলগুলোর সশস্ত্র তৎপরতা এবং এমন বেপরোয়া হত্যার ঘটনাকে সরকার গুরুত্বসহকারে নিয়েছে। এখন সরকার যেভাবে নির্দেশনা দিবে সেভাবেই আমরা পদক্ষেপ নিবো।