পার্বত্য জনপদের সবচে বড়,দীর্ঘমেয়াদী এবং সফল প্রকল্প হিসেবেই ইতোমধ্যেই দেশে বিদেশে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত ‘সমন্বিত সমাজ উন্নয়ন প্রকল্প’র ৪০০০ তম পাড়াকেন্দ্র রবিবার আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এবং ইউনিসেফ এর যৌথ উদ্যোগে রবিবার সকাল ১০ টায় ঢাকার প্যান ফ্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলের গ্র্যান্ড বলরুম হতে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার মিতিঙ্গ্যাছড়িতে নবনির্মিত পাড়াকেন্দ্রটি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী । এটি সমন্বিত সমাজ উন্নয়ন প্রকল্পের ৪০০০তম পাড়াকেন্দ্র, ১৯৮৩-৮৪ সালে এ্যাকশান রিচার্জ হিসাবে শুরু হওয়া এ প্রকল্পটি ১৯৮৫-১৯৯৫ মেয়াদে প্রথম পর্যায়, ১৯৯৬-২০১১ মেয়াদে দ্বিতীয় পর্যায় এবং ২০১২-২০১৮ মেয়াদে ৩য় পর্যায় বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ বছরেরই মার্চে তৃতীয় পর্যায়ে মেয়াদ শেষে প্রকল্পটি এসডিজি’র সাথে সমন্বয় রেখে টেকসই সামাজিক সেবা নামে নতুন আঙ্গিকে কার্যক্রম শুরুর প্রক্রিয়া চলছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম এলাকায় সার্ভিস সেন্টার হিসেবে বহুল পরিচিত এই পাড়াকেন্দ্র। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন সমন্বিত সমাজ উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়া এই পাড়াকেন্দ্রর মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের শিশু, কিশোরী ও নারীদের সেবা প্রদান করা হয়ে থাকে। এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো- সাধারণত একই ধর্ম ও সম্প্রদায়ের এবং একই ভাষাভাষী ৪০-৫০ টি পরিবারকে সেবা দেয়ার জন্য পরিচালিত একটি কেন্দ্র বা স্থান। তবে ক্ষেত্রবিশেষে একাধিক সম্প্রদায় বা কম সংখ্যক পরিবারের জন্যও একটি পাড়াকেন্দ্র থাকতে পারে। পাড়াকেন্দ্রের মাধ্যমে ৩-৬ বছর বয়সী শিশুদের জন্য প্রাক-শৈশব যতœ ও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা দান, গর্ভবতী, প্রসুতি ও নবজাতকের স্বাস্থ্য সেবা ও পরামর্শ দেয়া, প্রত্যক্ষ পুষ্টি কার্যক্রম পরিচালনা, স্বল্পব্যয়ী ও যথোপযুক্ত জীবন নির্বাহী কৌশল ও পদ্ধতির প্রদর্শন ও প্রশিক্ষণ দেয়া, শিশু সুরক্ষা, শিশু অধিকার ও নারীর অধিকার বিষয়ক ধারনা প্রদান ও কম্যুনিটি সদস্যদের এসব বিষয়ে আচরণগত পরিবর্তন সাধন করা,কম্যুনিটির হালনাগাদ তথ্য সংরক্ষন করা, কম্যুনিটি সভা করা, প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সামাজিক কাজে ব্যবহার করা হয় এই পাড়াকেন্দ্র। স্থানীয় একজন প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত নারীকর্মী কেন্দ্রটি পরিচালনা করেন।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার অধিকাংশ মানুষ দুর্গম এলাকায় বসবাস করে যেখানে মৌলিক সেবাসমূহ জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানো দুরূহ ও কষ্টসাধ্য এবং এ এলাকার অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র। সঙ্গত কারণেই এখানে মাথাপিছু আয় এবং ক্যালরী গ্রহণের হার জাতীয় হারের চেয়ে নিম্নে। স্বাস্থ্য সেবার প্রাপ্যতা, বিদ্যালয়ে ভর্তির হার, নারী শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসম্মত পয়:সুবিধা বিবেচনায় তিন পার্বত্য জেলা নিচের সারিতে অবস্থান করছে। এর প্রেক্ষিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার আর্থ-সামাজিক সূচকসমূহের উন্নয়ন; বিশেষ করে মা ও শিশুর সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বিশেষ ধরনের এ প্রকল্পটি বাংলাদেশ সরকার এবং ইউনিসেফ যৌথভাবে বাস্তবায়ন করে আসছে।
প্রকল্প ব্যবস্থাপক মো: জান-ই আলম জানিয়েছেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের ৪৭৩৪ টি পাড়ার মধ্যে ৩৫১৯টি পাড়ায় ১৬৫৩৪৩ পরিবারের ৮৫৯৭৮৪জনকে প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন সেবা প্রদান করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের কার্যক্রমের ফলে পার্বত্যবাসীর জীবনমানের উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন সাধিত হয়েছে; এ অঞ্চলে প্রাক-প্রাথমিকে ভর্তি হার জাতীয় হারের তুলনায় ১৩.৩৩ শতাংশ অধিক, পার্বত্যাঞ্চলে ১৪০টি কম্যুনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে গ্রামীন জনগোষ্ঠীর এক তৃতীয়াংশের আয়রন সাপ্লিমেন্টেশান করা হচ্ছে। বাকী দুই তৃতীয়াংশ পাড়াকেন্দ্রের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, ৪৪০০ জনের একটি প্রশিক্ষিত কর্মী বাহিনী তৈরী করা হয়েছে যারা সামাজিক পরিবর্তনের ভূমিকা পালনে সক্ষম। এদের ৯৫% মহিলা। সমন্বিত সমাজ উন্নয়ন প্রকল্প পার্বত্যবাসীদের জীবনমান উন্নয়নে মূল্যবান অবদান রেখেছে।
জন্ম নিবন্ধন, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি পরিস্থিতি উন্নয়ন, পানি ও পয়:ব্যবস্থার উন্নয়ন ও শিক্ষা ক্ষেত্রে পার্বত্যাঞ্চলে দৃশ্যমান অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। পাড়াকর্মীর জ্ঞান ও দক্ষতা, প্রকল্প বাস্তবায়নে কমিউনিটির অংশগ্রহণ এবং সেবা বিতরণে বিভিন্ন সংস্থার সম্পৃক্ততা পাড়াকেন্দ্রকে তৃণমূল পর্যায়ে সত্যিকার অর্থে সেবা বিতরণের কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত করেছে। সহযোগী সংস্থাসমূহের অংশগ্রহণের মাধ্যমে পাড়াকেন্দ্রের মাধ্যমে স্বাস্থ্য, শিশু শিক্ষা, পুষ্টি, পানি ও পয়ঃব্যবস্থা ও হাইজিন অভ্যাস গড়ে উঠার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক মো: ইয়াছিন জানিয়েছেন, ‘বর্তমানে ৩ পার্বত্য জেলার ২৬টি উপজেলায় ৪০০০টি পাড়াকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। যার সর্বশেষ ৪০০০তম পাড়াকেন্দ্রটি রোববার প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন। ৪০০০তম পাড়াকেন্দ্র উদ্বোধন অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে তিন পার্বত্য জেলায় উৎসবের আমেজ দেখা দিয়েছে। পার্বত্যবাসী প্রত্যাশা করছেন প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের মাধ্যমে এ এলাকার মানুষের সেবাপ্রাপ্তির এই স্থায়িত্ব দীর্ঘায়িত হবে।’
প্রকল্পটির বাস্তবায়নাকারি সংস্থা পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ও পার্বত্য সচিব নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা জানিয়েছেন,পার্বত্য জনপদের শান্তি,স্থিতি ও উন্নয়নের পথে এই প্রকল্পটি একটি মাইলফলক হিসেবে বিশাল অবদান রাখছে। এর মাধ্যমে পার্বত্য এলাকার দুর প্রত্যন্ত এলাকাতেও সরকারের সেবা ও কর্মসূচী পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয়েছে। ৪০০০ তম পাড়াকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে প্রমাণ করেছে তারা কাংখিত ও প্রত্যাশিত পথেই আছে। একই সাথে পাড়াকেন্দ্রগুলোর আয়তন বৃদ্ধি,স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ এবং এটাকে গ্রাম পর্যায়ে একটি সমন্বিত সেবাকেন্দ্র হিসেবেই দেখতে চাইছি আমরা,সেই লক্ষ্যেই কাজ চলছে।’