প্রতিবছর ঈদের ছুটিতে ব্যস্ত কর্মজীবন থেকে কিছু সময়ের জন্য মুক্তি পাওয়া ভ্রমণ পিপাপু হাজারো মানুষ ক্লান্তি নিবারণের জন্য ছুটে আসেন রাঙামাটিতে। আসবেন নাইবা কেন? পুরো শহরটা জুড়েই সারি সারি সবুজ পাহাড়ের মেলা,পাহাড়ের গায়ে ভেসে চলা সাদা মেঘের দল যে কারো দৃষ্টি কাড়বে সহজেই,কাপ্তাই লেকে ছড়িয়ে পরা গোধূলীর শেষ আলোকছটার অপার সৌন্দর্য্য,পাহাড় বেয়ে নেমে আসা ঝর্ণা আর তার মনোমুগ্ধকর রূপের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ আর কোথাইবা আছে !!!
রাঙামাটিতে ঘুরতে আসা পর্যটকদের প্রিয় পর্যটন স্পট গুলোর মধ্যে,ঝুলন্ত ব্রীজ,শুভলং ঝর্ণা,রাজবন বিহার,বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের সমাধি সৌধ,জেলা প্রশাসকের বাংলো,বালুখালি কৃষি ফার্ম এবং ইকো ভিলেজ অন্যতম। পাহাড়ি মানুষদের জীবন যাপন,তাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি,তাদের হাতে তৈরি বিভিন্ন সামগ্রীও পর্যটক দের অন্যতম আকর্ষণ। তাইতো প্রতিবছর ঈদের ছুটিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রাঙামাটিতে ভীড় করে হাজারো পর্যটক। বিদেশি পর্যটকদের ও দেখা মেলে পাহাড় লেকের নগরী রাঙামাটিতে।
কিন্তু রাঙামাটিতে পাহাড় ধসের পর চিত্র টা পালটে গেছে। ৫ জন সেনা সদস্য সহ পাহাড় ধসে মারা গেছে শতাধিক মানুষ। ঝুঁকির মুখে রাঙামাটির বিভিন্ন এলাকা। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পরেছে। ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রাঙামাটি চট্টগ্রাম সড়ক।দূর্যোগ পরবর্তী কয়েক দিন যান চলাচল একেবারে বন্ধ ছিল।এখন কিছুটা স্বাভাবিক হলেও যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরোপুরি ঠিক হয়নি। পাহাড় ধস,বৃষ্টি আর সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় রাঙামাটি এবার ছিল প্রায় পর্যটক শূণ্য।পর্যটক অভাবে পর্যটন শিল্পকে ঘিরে গড়ে উঠা বিভিন্ন ব্যবসায়কে সম্মুখিন হতে হয় বিরাট অংকের লোকসানে। এই বিষয়ে জানতে চাইলে হোটেল লেকসিটির স্বত্বাধিকার এবং রাঙামাটির বিশিষ্ট কবি হাসান মাহমুদ মনজু পাহাড়টোয়েন্টিফোর ডট কমকে জানান,”প্রতি বছর ঈদ মৌসুমে প্রচুর পর্যটক আসে রাঙামাটিতে।ওই সময়ে হোটেলের প্রতিটি কক্ষই থাকে পর্যটকে পূর্ণ। কয়েকদিন আগে থেকেই রুম বুকিং দিত পর্যটকরা। অনেক সময়ই রুম খালি না থাকায়,পর্যটকদের ফিরিয়ে দেওয়া হতো। কিন্তু এবারের কথা আলাদা। পর্যটক শূন্য রাঙামাটির হোটেল রুম গুলোও প্রায় খালি পরে আছে।’
তিনি আরো জানান,‘এবারে রাঙামাটির প্রতিটি হোটেল ব্যবসায়ীকেই গুণতে হচ্ছে বড় আকারের লোকসান। এবারের ঈদ পর্যটন মৌসুমকে ঘিরে পর্যটক আকর্ষনের জন্য নেওয়া বিভিন্ন আয়োজন সবই বৃথা গেছে।’ এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন,‘পাহাড় ধসের ফলে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পরেছে। প্রতিবছর বিভিন্ন জেলা থেকে পিকনিক করতে আসে অনেকেই। বড় গাড়ি বিশেষ করে বাস ঢুকতেই না পারাই এবার কোন জেলা থেকেই কেউ আসে নি পিকনিকে।আর রাঙামাটির পাহাড় ধস কে ঘিরে বাংলাদেশের মানুষের মনে একটি সংশয় কাজ করছে তা ছাড়া বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে রাঙামাটি কে নিয়ে বাড়িয়ে লেখাকেও তিনি পর্যটক দের রাঙামাটিতে আসার অনাগ্রের কারণ হিসেবে দায়ী করেন।’
তিনি পাহাড়টোয়েন্টিফোর ডট কম এর মাধ্যমে সরকার এবং প্রশাসনকে জানান চান, যেন খুব শীঘ্রই রাঙামাটির সাথে চট্টগ্রামের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক করার, নেওয়া উদ্যোগ অবিলম্বে বাস্তবায়ন করা হয়।
তিনি আরো বলেন, পর্যটক প্রিয় পর্যটন নগরী রাঙামাটির পর্যটন স্পট গুলোর আরো উৎকর্ষতা সাধনা করা হোক। বিশেষ করে, শুভলং এর উজানে বাধ দিয়ে সারা বছর ঝর্ণা প্রবাহিত করার ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি পর্যটক আকর্ষন বৃদ্ধির জন্য রাঙামাটিতে ক্যাবল কারের ব্যবস্থা করা হোক।
পাহাড়ি মানুষদের তাঁতে তৈরি কাপড়ের পাশাপাশি হাতে তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী বেশ কদর রয়েছে ঘুরতে আসা পর্যটকদের কাছে। শুধু পর্যটকদের কাছেই নয়,সারা বাংলায় এই শিল্প প্রসিদ্ধ।তাই রাঙামাটির বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠেছে অনেক গুলো এসব পোশাকে বেশ কিছু বিপনী বিতান। বিভিন্ন পর্যটক মৌসুমে এই বিপনী গুলোতে ভিড় করেন পর্যটকরা। কিন্তু এবার দেখা গিয়েছে ভিন্ন চিত্র। প্রায় প্রতিটি বিপনীই খালি। কর্মীরা একে অন্যের সাথে গল্প করে অলস সময় কাটাচ্ছেন। ঈদে আগত পর্যটক দের কথা মাথায় রেখে, এই বিপনী মালিকরা আগে থেকেই নিজেদের টেক্সটাইলে প্রস্তুত করে রাখা বিভিন্ন সামগ্রী যেমন তাতে বোনা খাদি,পিনন,থামি সহ বিভিন্ন কাপড় এবং হাতে তৈরি বিভিন্ন গৃহস্থালি সামগ্রী,বাশ ও কাঠের তৈরি বিভিন্ন ঘর সাজানোর সামগ্রী ক্রেতার অপেক্ষায় অলস হয়ে পরে আছে।
রাঙামাটির ঐতিহ্য বাহী বেইন টেক্সটাইলের স্বত্বাধিকার মঞ্জুলিকা চাকমার ছেলে কৌশিক চাকমা বলেন,‘ব্যবসা একেবারেই ঠান্ডা। গত বারের তুলনায় এবার ব্যবসা নেয় বললেই চলে। প্রতি বছর এই সময়ে পর্যটক দের যে একটা ভীড় লেগে থাকতো এবার তা নেয়। চাকমা কাপড়ের খুব চাহিদা রয়েছে এখানে আসা পর্যটক দের সেটা মাথায় রেখে প্রতিবছরের মতো এবারো তৈরি করা হয়েছিল প্রচুর থামি,খাদি,পিনন এবং তাতে বোনা কাপড়।কিন্তু পর্যটক না থাকায়,কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন হয় নি এইবার।’
তিনি আরো বলেন, এভাবে চলতে থাকলে এই ব্যবসা করা ব্যবসায়ীদের গুণতে হবে বড় আকারের লোকসান। বিক্রি হচ্ছে না,কিন্তু উৎপাদন কর্মী এবং বিক্রয় কর্মীদের বেতন ঠিকই দিতে হচ্ছে।এভাবে চলতে থাকলে ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প ধ্বংসের মুখে গিয়ে দাঁড়াবে। সরকারের এই দিকে সুনজর দেওয়া উচিত।দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক করার পাশাপাশি পর্যটকদের রাঙামাটি মুখী করার উদ্যোগ নিতে হবে সরকারের।’
কাপ্তাই লেকের সৌন্দর্য্যের কথা কে না জানে!! কাপ্তাই লেকের আশেপাশে গড়ে উঠেছে অনেক গুলো পর্যটন স্পট।আর এই পর্যটন স্পট গুলো ঘুরে দেখার জন্য টুরিস্ট বোটের বিকল্প যান আর কিছুই নেয়। তাই রাঙামাটি দেখতে আসা দর্শনার্থীদের টুরিস্ট বোটের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করে আসছে অনেক টুরিস্ট বোট ব্যবসায়ী। সারা বছর তারা পর্যটন মৌসুমের অপেক্ষায় থাকে। তবলছড়ি, পর্যটন ঝুলন্ত সেতুর আশেপাশের এলাকার প্রায় ৮০% লোক টুরিস্ট বোট ব্যবসার সাথে জড়িত। বর্তমানে সৃষ্ট পরিবেশের ফলে তাদের অলস সময় কাটছে।
বেশ কয়েকটি টুরিস্ট বোটের মালিক মো: আলাউদ্দিন টুটুল জানান, “গত ঈদের তুলনায় এবারের ঈদে ১৫% এরও কম উপার্জন হয়েছে। সারাদিন অপেক্ষার পর হয়তো এক আধটা পর্যটকের দেখা মেলে।অনেক পরিবার এর ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে। এই সময়ে অর্থনৈতিক সমস্যার পাশাপাশি বেকারত্ব ও বেড়ে গেছে।’
তিনি আরো জানান,‘সামনে আরেকটি পর্যটন মৌসুম আসছে।আমরা ওই সময়ের অপেক্ষায় আছি।’ তিনি আশাবাদী এই সময়ের মধ্যেই রাঙামাটির সৃষ্ট পরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে আসবে।আবারো রাঙামাটি পূর্ণ হবে দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসা পর্যটকে।সাথে সাথে তাদের বর্তমান অবস্থার ও পরিবর্তন ঘটবে।
রাঙামাটি,পর্যটক রা যাকে মিনি সুইজারল্যান্ড নামে আখ্যায়িত করে,সেই পর্যটন নগরী ছিল না একেবারেই পর্যটন শূণ্য।এক আধ জন ঠিকই চলে এসেছে রাঙামাটির রূপ মাধুর্যের সাথে মিতালি করতে।
তেমনি একজন পার্থ খান, ঢাকায় থাকেন,তার সাথে দেখা হয়ে যায় পর্যটন ঝুলন্ত ব্রীজ এলাকায়। রাঙামাটিতে কেমন লাগছে? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন,”রাঙামাটি আমার এইবার প্রথম আসা না। এর আগে ও বেশ কয়েক বার এসেছি। শেষ বার এসেছি তিন মাস আগে বিশেষ এক কাজে। এবার ও এসেছি কাজে সাথে ঘোরাঘুরি। বেশ ভালোই লাগে রাঙামাটি,রাঙামাটির পাহাড় লেক প্রকৃতি।’
আগের দেখা রাঙামাটি আর এবার দেখা রাঙামাটির মধ্যে কি পার্থক্য চোখে পড়ছে।’ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পানি আগে অত বেশি ছিল না।এখন লেকের পানি অনেক বেড়ে গেছে। আসার পথের রাস্তার অবস্থা বেশ খারাপ। আগের বারের পাহাড় গুলো সবুজে ডাকা ছিল। এবার এমন কোন পাহাড় চোখে পড়েনি, যেটা অক্ষত। যেন কেউ খাবলা দিয়ে মাটি সরিয়ে ফেলেছে। আর প্রতিটি পর্যটন স্পটে প্রচুর মানুষের ভীড় ছিল এবার প্রায়ই খালি।’
পর্যটন নগরী রাঙামাটির পর্যটন ব্যবসায়ীরা কাটাচ্ছেন প্রতিকূল সময়।সবাই চায়ছেন,খুব দ্রুত বর্তমান পরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে আসুক।সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার খুব দ্রুত উন্নতি সাধন করা হোক। সরকার রাঙামাটি পর্যটন খাতে নজর দিক এবং এর উৎকর্ষতা সাধন করুক।পর্যটক দের রাঙামাটি মুখী করার জন্য সরকার যথাযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহন করুক।সরকার খুব দ্রুত রাঙামাটির দর্শনীয় স্থান গুলোর আরো সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করবেন,এই আশায় ব্যক্ত করেন অনেকেই।
তবে আশার কথা শোনালেন রাঙামাটি পর্যটনের ব্যবস্থাপক আলোক বিকাশ চাকমা। তিনি জানালেন, যে প্রাকৃতিক বিপর্যয় হয়ে গেছে,তার কিছুটা প্রভাব অন্যান্য সকল সেক্টরের মতো পর্যটনেও পড়বে খুব স্বাভাবিক। হয়েছেও তাই। তবে ধীরে ধীরে ঘুরে দাড়াচ্ছে রাঙামাটি ও রাঙামাটির পর্যটন। আমরা আশা করছি,রাঙামাটি তার পুরনো চেহারায় আবির্ভূত হবে এবং পুরনো রূপই ফিরে পাবে। আমার বিশ্বাস আবারো পর্যটকের পদভাবে মুখর হয়ে উঠবে এই শহর।
1 Comment
প্রাকৃতিক পরিবেশ পিরিয়ে আনলে হয়ত এই পাহাড় ধস হতে রক্ষা পেতে পারি।