খাগড়াছড়িপ্রকৃতিপুরাণ

পর্যটনের নতুন সম্ভাবনা বিল্ল্যোছড়া ঝর্ণা

ভ্রমণপ্রিয় আর হাঁটতে যারা ভালোবাসেন, তাদের কাছে অবশ্যই আদর্শ জায়গা পাহাড় আর পাহাড়ের গহীনে অবস্থিত জলপ্রপাত। দুর্গম পাহাড়ি পথে ট্র্যাকিং, ঝিরি পথ পেরিয়ে জনহীন বুনো অরণ্য আর প্রকৃতির একান্ত সান্নিধ্য পেতে কে না-চায়!

ভ্রমণপিয়াসী মানুষেরা প্রতিনিয়ত খুঁজে নেয় প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যমন্ডিত স্থান। সবুজ পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে অবাক করা রূপবৈচিত্র্য। বর্ষায় ঝর্ণাগুলো প্রাণচাঞ্চল্যে ভরে উঠে। মনের খোরাক মিটাতে পাহাড়, ঝিরি-ঝর্ণাময় খাগড়াছড়ি জেলার ভগবান টিলা হতে পারে ভ্রমণের সেরা স্থান। করোনা সংকট কেটে গেলে ভ্রমণপিপাসু মানুষজন পাবে বিনোদনের এক নতুন ঠিকানা।

যাঁরা একঢিলে চার পাখি মারতে চান, তাঁদের জন্য এটি হতে পারে অনন্য একটি স্থান। যেতে যেতে নির্মল বাতাস আর গ্রামীণ পরিবেশ যে-কারো ভালো লাগবে। এখান থেকে ভারতের বাড়িঘর দেখা যায়।

রোমাঞ্চকর পথ। প্রকৃতির অনন্যসাধারণ বৈচিত্র্যময় রূপ দেখতে দেখতে উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথে জীপ, মোটরবাইকের পর পায়ে হেঁটে ভ্রমণ আর ঝর্ণায় গোসল শেষে প্রতিবেশী দেশ ভারত-এর আকাশ দেখতে দেখতে মাচাং ঘরে খাবার খাওয়া; একসাথে এতোকিছুর সুযোগ করে দিতে পারে মাটিরাঙ্গার ভগবান টিলা ও ভারতীয় সীমান্তবর্তী একটি ঝর্ণা। ভগবান টিলা ও ঝর্ণাটি জেলার পর্যটনে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। ভগবান টিলা হতে এর দূরত্ব প্রায় দেড় কিলোমিটার। নাম বিলে­্যাছড়া ঝর্ণা। খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলায় পড়লেও জেলা সদর হতে পানছড়ি উপজেলা দিয়ে কাছে হয়। ছড়ার “বিল্ল্যো” নামটি এলাকার একজন ব্যক্তির নাম। ঘটনাচক্রে তার নামে এই ঝর্ণাটির নামকরণ হয় বলে জানিয়েছেন স্থানীয়দের কয়েকজন। অনেকে একে বিল্লোচ্ছুবি ঝর্ণা নামও ডেকে থাকেন। প্রায় ১২০ ফুট উঁচু ঝর্ণাটিতে রয়েছে তিনটি ধাপ। এর নিচে এবং এলাকার আশপাশে আরো ঝর্ণা রয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১ হাজার ৬শ’ ফুট উপরে অবস্থিত ভগবান টিলা। সামনে চোখ জুড়ানো দিগন্ত জোড়া সবুজ পাহাড়। জুম ক্ষেত। পাহাড়ের থেকে নেমে আসা ঝরনাধারা কলকলিয়ে পাহাড়ের বুক চিরে বহমান।

‘ভগবান টিলা’ স্থানীয়দের কাছে “বি-টিলা” নামে অধিক পরিচিত। মাটিরাঙ্গা উপজেলা সদরের শেষপ্রান্তে ভারতের সীমান্ত ঘেঁষা তাইন্দনংয়ে এটি অবস্থিত।

খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলা থেকে সোজা উত্তরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ‘ভগবান টিলা’। খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে উত্তর-পশ্চিমে এর কৌণিক দূরত্ব আনুমানিক ৮৫ কিলোমিটার। সবুজের বুকে আঁকাবাঁকা আর উঁচু-নিচু পথের শেষে অবস্থিত৷ টিলায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এর পর্যবেক্ষণ চৌকি রয়েছে। প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। চারদিকে পাহাড়ের বুকজুড়ে সবুজে ঘেরা কচুক্ষেত, বাঁশের ঝোঁপ। নানান ধরনের পাখির ডাক আর পাহাড়ের বুকে বয়ে যাওয়া ঝরনায় অবগাহনে হারিয়ে যাওয়ার এক অনন্য স্থান। তবে পথ নির্দেশনা চিহ্ন নেই বলে জানিয়েছেন পর্যটকগণ। গাইড ছাড়া যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। ঝর্ণাটি সদ্য আবিষ্কৃত। দেখে মনে হতে পারে এ-হয়তোবা প্রাগৈতিহাসিক যুগের কোন চিত্র।

নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে ভগবান টিলা পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তোলা গেলে, করোনা সংকট কেটে গেলে মানসিক শান্তির খোঁজে দেশ-বিদেশের ভ্রমণপিপাসু পর্যটক আসবে। কেবল উদ্যোক্তা, পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। এর পাশাপাশি বিল্ল্যোছড়া ঝর্ণাকে কেন্দ্র করে বদলে যাবে মাটিরাঙ্গা উপজেলার তাইন্দং ও ভগবান টিলা, পানছড়ি উপজেলার সীমান্তবর্তী লোগাং আমতলী, চিকনচান পাড়া, মিলধন পাড়া ইত্যাদি এলাকার আর্থ-সামাজিক অবস্থা। ভগবান টিলা ছাড়াও এখানে রয়েছে একাধিক ঝরনাধারা। যা ইতোমধ্যে স্থানীয়দের বিনোদনের উৎস হয়ে উঠছে।

বিল্ল্যোছড়া ঝর্ণায় যাওয়ার ৩টি পথ রয়েছে। খাগড়াছড়ি-মাটিরাঙ্গা-তবলছড়ি-তাইন্দনং-ভগবান টিলা হয়ে গেলে দূরত্ব (আনুমানিক ৮৫কিলোমিটার) বেশি তবে হাঁটতে হবে কম। আবার খাগড়াছড়ি-পানছড়ি-তবলছড়ি মোড়-তাইন্দনং-ভগবান টিলা হয়ে গেলেও দূরত্ব খুব বেশি কমে না কিন্তু পানছড়ি-লোগাং-আমতলী হয়ে গেলে দূরত্ব কমে যাবে প্রায় অর্ধেক। তবে এই পথে ৬ ছয় কিলোমিটার হাঁটতে হবে। যারা ট্রেকিং পছন্দ করেন তাদের জন্য আদর্শ। খাগড়াছড়ি হতে পানছড়ি ২৫ কিলোমিটার এবং পানছড়ি হতে লোগাং ১১ কিলোমিটার ও আমতলী হতে মিলোধন পাড়া পর্যন্ত ৮ কিলোমিটার। ৪ কিলোমিটার হেঁটে ভগবানটিলা আর দেড় কিলোমিটার পর নয়নাভিরাম বিল্ল্যোছড়া ঝর্ণায় পৌঁছে যাবেন। এই পথে পিচ রাস্তা, ইটের রাস্তা, মেঠোপথ সবই পাবেন। গাছগাছালি নলখাগড়া ঘেরা আঁকাবাঁকা উঁচু-নিচু পথ। পাহাড় বেয়ে ওঠানামা সতর্ক থাকতে হবে নয়তো ঘটে যেতে পারে অনেক বড় দুর্ঘটনা। জুতা যেমনই নেন-না কেন, তা যেন মাটি আঁকড়ে ধরে এমন হয়। যত বেশি বোঝা কম নেবেন তত ভালো। পাহাড় বেয়ে ওঠা-নামার জন্য একটি লাঠি/বাঁশ আর হালকা খাবার, সুপেয় পানি নিয়ে যাবেন। পানি অবশ্যই নিয়ে যাবেন। হাঁটা শুরুর দুটি পাহাড় আর ঝর্ণায় নামার আগের রাস্তাটি সবচেয়ে বেশি রোমাঞ্চকর। শেষেও এই দুটি জায়গায় সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে থাকেন পর্যটকগণ। ভালো জুতো না নিয়ে গেলে, এই স্থানসমূহ খালি পায়ে পাড়ি দিতে চেষ্টা করতে হবে। উত্তেজনাপূর্ণ রোমাঞ্চকর এডভেঞ্চার শেষে পৌঁছে যাবেন কাক্সিক্ষত গন্তব্যে। মনে হতে পারে প্রাগৈতিহাসিক যুগে ফিরে গিয়েছেন। সুউচ্চ পাহাড়ের ওপর থেকে পাথরের দেয়ালে আছড়ে পড়ছে ঝর্ণার সুশীতলধারা। যে ধারায় গা ভিজিয়ে সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।

পানছড়ি বাজারের তরুণ ব্যবসায়ী রিপন চৌধুরী বন্ধুদের নিয়ে বেড়িয়েছেন ক’দিন আগে। তিনি জানান, “ঝর্ণাটি গিয়ে অনেক ভালো লাগলো। আল্লাহ তা আলা প্রকৃতির মধ্যে অনেক কিছু রেখে দিয়েছেন মানুষের জন্য। ওইখানে গিয়ে মনের গহীনে হারিয়ে গিয়েছিলাম। করোনা সংকট কেটে গেলে আশা করি এটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।”

এলাকাটি ঘুরে এসেছেন উল্টাছড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম বাবুল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবিও শেয়ার করেছেন। তিনি বলেন, “আমার পোস্টের কিছু কমেন্ট পড়ে বুঝলাম, অনেকেরই স্থানটি মনে ধরেছে। এটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় স্থান। তবে কষ্টদায়কও বটে। যারা এই ভ্রমণে যাবেন তারা জেনে-বুঝে, নিশ্চিত হয়েই যাবেন।”

পানছড়ি উপজেলা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি নূতন ধন চাকমা ভগবান টিলা বিল্ল্যোছড়া ঝর্ণার অনন্য রূপ দেখে মুগ্ধ। আবারও যেতে চান। তিনি বলেন, “এটি খুব সুন্দর একটি পর্যটন কেন্দ্র হতে পারে। স্থানীয়দের জীবনধারার প্রতি সম্মান ও ঐতিহ্য বজায় রেখে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হলে এর আশপাশের এলাকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটবে। অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।”

এই বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

two × one =

Back to top button