শংকর হোড়
১০ বছর পর রাঙামাটি জেলা আওয়ামীলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ২০১২ সালে সবশেষ কাউন্সিলে দীপংকর-মুছা কমিটি গঠনের পর এক দশক এই কমিটি জেলা আওয়ামীলীগের নেতৃত্ব দিয়েছেন। মধ্যখানে ২০১৯ সালে ২৫ নভেম্বর সম্মেলনের তারিখ নির্ধারিত হওয়ার পরও তার ঠিক ২-৩দিন আগে সম্মেলন স্থগিত করা হয়। এরপর আরো দুইবছর অতিবাহিত হয়েছে। অবশেষে ২৪ মে হতে যাচ্ছে কাক্সিক্ষত সেই সম্মেলন।
এবার সম্মেলনের তারিখ নির্ধারিত হওয়ার পর থেকে প্রথমেই আলোচনা শুরু হয় কে হচ্ছেন সাধারণ সম্পাদক? গত ২৬ বছর ধরে জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি দীপংকর তালুকদার। এই সময়ে যেসব কাউন্সিল হয়েছে কোনটাতেই দীপংকরের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। দলে তাঁর একক আধিপত্যসহ নানান সমীকরণে এবারও দীপংকর তালুকদার একক প্রার্থী হিসেবে আবারো সভাপতি নির্বাচিত হবেন এমনটাই প্রত্যাশা করছিল নেতাকর্মীরা। কিন্তু হঠাৎ একটি ঘোষণাতেই রাঙামাটির রাজনীতির অঙ্গণে হঠাৎ যেন বৈশাখী ঝড় উঠে গেলো। একসময়ের দীপংকর তালুকদারেরই আস্থাভাজন নিখিল কুমার চাকমা ঘোষণা দেন সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বীতার, আর সেই থেকে যেন সভাপতি পদ নিয়ে কৌতুহল না থাকা রাজনীতিবিদদের এখন সব কৌতুহল যেন সভাপতি পদ ঘিরেই। আর তাই তো প্রথমেই সাধারণ সম্পাদক নিয়ে সকলের কৌতুহল থাকলেও এখন সেই আলোচনার ঝড় চলছে সভাপতি পদ ঘিরে।
দীপংকর তালুকদার পাহাড়ের আওয়ামীলীগের রাজনীতির বরপুত্র বলে মানেন অনেক রাজনীতিবিদ। যাকে রাঙামাটির রাজনীতিতে অনেকটাই একচ্ছত্র নেতা হিসেবেই ভাবা হয়। দীপংকর তালুকদারের রাজনৈতিক জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও কূটনৈতিক চিন্তা-চেতনার কারণে এই অঞ্চলে তাঁর নেতৃত্ব অনেকটাই একক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরে যার ভূমিকা ছিল অনন্য, সেই দীপংকর তালুকদার চুক্তিস্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতির সাথে এক তেল-জলে অমিশ্রণ পদার্থ। চুক্তির পূর্বে জনসংহতি সমিতির তাঁর ঘনিষ্ঠতা এখন সেটা শত্রু পর্যায়ে চলে এসেছে। তাই তো প্রকাশ্যে দেখা যায় দীপংকর তালুকদার ও জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা(সন্তু লারমা) একে অন্যকে বাক্যবাণে বিদ্ধ করছেন। অর্থাৎ পাহাড়ের আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে বিশেষ করে রাঙামাটির রাজনীতিতে জনসংহতি সমিতি বড় একটা ফ্যাক্টর। তাই তো রাঙামাটি আওয়ামীলীগ বিএনপিকে নিয়ে যত না মাথা ঘামায় তার চেয়ে বেশি মাথা ঘামাতে হয় জনসংহতি সমিতিকে নিয়ে। আর আওয়ামীলীগের এই কৌশলী কূটচালের পুরোটা দীপংকর তালুকদারকেই নেতৃত্ব দিতে হয়। জনসংহতি সমিতির নেতারাও চুক্তি বাস্তবায়নে স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতাদের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে এমন অভিযোগ হরহামেশাই করে আসছেন।
আওয়ামীলীগের সম্মেলনকে ঘিরে বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণার পর থেকেই স্থানীয় আওয়ামীলীগের রাজনীতির উত্তাপ বেড়ে গেছে। কারণ এইক্ষেত্রে দীপংকর তালুকদারকে চ্যালেঞ্জ দেয়া অনেকটাই সাহসের ব্যাপারই বলছেন কাউন্সিলররা। তবে নিখিলের উপস্থিতিতে কিছুটা বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে দীপংকর তালুকদারকে। কারণ এক্ষেত্রে নিজ দলীয় কাউন্সিলরদের মন জয় করার পাশাপাশি, অদৃশ্যভাবে জনসংহতি সমিতির কিছুটা প্রভাব, একসময়ের মিত্র বর্তমানে শত্রু হওয়া সতীর্থ এবং পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীত্ব ঘিরে পার্বত্য রাজনীতির জটিল হিসাবনিকাশ দীপংকর তালুকদারকে ভোগাচ্ছে। যা সুবিধা হিসেবে দেখছেন নিখিল কুমার চাকমা।
২৪৬ কাউন্সিলরদের মধ্যে কথা হয় বেশ কয়েকজন কাউন্সিলরদের সাথে। নিজেদের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব কাউন্সিলরদের কাছে প্রশ্ন ছিল নিখিলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা কেমন ভোগাবে দীপংকরকে? তাদের অনেকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়টি ‘অনেকটাই’ উড়িয়ে দিলেও কয়েকজন ‘হিসাবটা সহজ নয়’ এমনটাই দাবি করেছেন। কাউন্সিলররা জানান, দীপংকর তালুকদার গত ২৬ বছর ধরে জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি পদে রয়েছেন। এসময় তিনবার তিনি দলকে রাঙামাটি আসনটি দলকে উপহার দিতে পারলেও দুইবার পারেননি। সভাপতি দায়িত্ব নেয়ার প্রথম দিকে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল। এরপর চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে প্রায়শ তার সাথে জেএসএসের ঝগড়া-বিবাদ প্রকাশ্যেই ঘটেছে। চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে মান-অভিমান রয়েছে, আর সেই মান-অভিমানের কিছুটা প্রভাব এই সম্মেলনে পড়তে যাচ্ছে। চুক্তি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অনেক বৈরিতাই তাকে সামাল দিতে হয়েছে, এজন্য শত্রুও সৃষ্টি হয়েছে তাঁর। পাহাড়িদের মধ্যে আওয়ামীলীগ করলেই তাকে হত্যা বা হুমকি দেয়া হচ্ছে, এসবও সামাল দিতে হয়েছে দীপংকর তালুকদারকে। এসব বিষয় সামাল দিতে গিয়ে সবার মন রক্ষা করতে পারেননি তিনি। এতে অনেকেই তাঁর ওপর অভিমানও করেছে। কাউন্সিলররা জানায়, রাঙামাটিতে আওয়ামীলীগ হিসেবে দলকে দাঁড় করাতে দীপংকরের ভূমিকা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। তবে কি আবারো সভাপতি পদে জয়লাভ করবে দীপংকর তালুকদার? এসমন প্রশ্নের জবাবে কয়েকজনের বক্তব্য হচ্ছে জয়ের পথে থাকলেও সহজ হবে না তাঁর এবারের কাজটা। কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছেন, দলে দীর্ঘদিন নেতৃত্ব দেয়ার কারণে দীপংকর তালুকদারের মধ্যেও ‘অহংকার’ চলে এসেছে। যার ফলে কোনও সিদ্ধান্তই দলের নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে তিনি করেন না। সিনিয়র নেতারা তাঁর বাসায় গেলে তাঁর সাথে কথা বলাটা নির্ভর করে ‘মুডের’ ওপর। মুড ভালো থাকলে কথা বলেন আর ভালো না থাকলে সবার সামনেও চিৎকার-চেঁচামেচি করেন। এতে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে অভিমান কাজ করে। ‘ভালোভাবে কথা বলতে না পারা’ আর জেলা পরিষদ থাকাকালীন এবং উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকে নিখিল কুমার চাকমা নেতাকর্মীদের বিভিন্ন কাজের সুবিধা দেয়ার কারণে অনেক কাউন্সিলর নিখিল কুমার চাকমাকে বেছে নিতে পারেন এমনটাই মত কাউন্সিলরদের। অর্থাৎ দীপংকর বিরোধিতা, সঠিক মূল্যায়নের অভাব ও উন্নয়ন কাজের জন্য অনেক কাউন্সিলর নিখিল কুমার চাকমাকে ভোট দিতে পারেন কাউন্সিলে।
তবে বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর জেলা আওয়ামীলীগের নেতৃত্ব দেয়া নিয়ে নিখিল কুমার চাকমার সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের দাবি, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ার আগে নিখিল কুমার চাকমার নামই তো কেউ জানতো না। তিনি পুরো রাজনীতিই করেছেন ক্ষমতাকেন্দ্রিক, বিরোধীদলের নেতৃত্ব এবং পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনীতির যে ফ্যাক্টর সেটা তিনি সামাল দিতে হিমশিম খেতে পারেন বলে তাদের মত। এসব বিবেচনায় এবং স্থানীয় রাজনীতিতে শেকড় থেকে শিখর পর্যন্ত দীপংকর তালুকদারের চেনা পরিবেশ এবং নিজের হাতে কমিটি গঠনের কারণে অনেকটাই বাধাহীনভাবে জয়লাভ করবেন এমনটাই দাবি কাউন্সিলরদের। পাশাপাশি স্থানীয় রাজনীতির সমীকরণে অনেক কাউন্সিলরই আপাতত দীপংকর তালুকদারের বিকল্প নেই এমনটাই ভাবছেন। তবে অনেক কাউন্সিলের মতে, ভবিষ্য আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে দীপংকর পরবর্তী নিজেকে তৈরি করার উদ্দেশেই দীপংকর তালুকদারকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন নিখিল। আর জেলা পরিষদের দ্বিতীয়বার চেয়ারম্যানে দীপংকর তালুকদারের অসহযোগিতা এবং উন্নয়ন বোর্ডে চেয়ারম্যান হওয়ার পথে পরোক্ষভাবে বাধাদান এবং কাউন্সিল পরবর্তী দলীয় কমিটিতে নিজের পদবি ঠিক রাখার লক্ষ্যে নিখিল কুমার চাকমা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন এমন মত দিচ্ছেন কিছু কাউন্সিলর। তবে কাউন্সিরররা জানাচ্ছেন, যেই হোক না কেন দলের আদর্শ ও উদ্দেশ্য এবং আগামী সংসদ নির্বাচনে দলীয় আসন যাতে আবারো শেখ হাসিনাকে উপহার দিতে পারে এমন নেতৃত্ব জয়লাভ করুক।
কাউন্সিলর ও সাবেক পৌর মেয়র হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, পার্বত্য জেলার রাজনীতি সমতলের চেয়ে আলাদা। এখানে ত্রিমুখী রাজনীতি বিদ্যমান। এই ত্রিমুখী রাজনীতির মধ্যে যারা আওয়ামীলীগের রাজনীতি এবং অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি করছেন, তারা সুবিধাজনক অবস্থায় নেই। তিনি বলেন, যারা আওয়ামীলীগের আদর্শ এবং অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি চর্চা করছেন, আগামী সম্মেলনে তাদেরকেই জয়যুক্ত করার জন্য কাউন্সিলরদের কাছে অনুরোধ থাকবে।
কাউন্সিলর ও সাবেক জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম সাইদুল বলেন, আগামী ২০২৩ সালের সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে রাঙামাটি আসন উপহার দেয়ার লক্ষ্যে শক্তিশালী একটি নেতৃত্ব নির্বাচিত হোক এটাই আমাদের প্রত্যাশা থাকবে।
জেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সভাপতি নিখিল কুমার চাকমা বলেন, দলীয় নেতাকর্মী ও কাউন্সিলরদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে আমি সভাপতি প্রার্থী হয়েছি। জয়ের ব্যাপারে আমি শতভাগ আশাবাদী। জয়ী হলে দলীয় আদর্শ ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পার্বত্য রাঙামাটিতে আওয়ামীলীগকে আরো শক্তিশালী করা হবে।
এই প্রসঙ্গে জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও খাদ্য মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি দীপংকর তালুকদার এমপিকে মুঠোফোনে কল দিয়ে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।