সুহৃদ সুপান্থ
স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র দীপংকর তালুকদার যখন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হন,তা যতটা বিস্ময়ের ছিলো,তারচেয়েও বেশি অবাক করা খবর ছিলো,জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গঠিত প্রতিরোধ বাহিনীর অন্যতম সদস্য,হ্রদ পাহাড়ের শহর রাঙামাটির চাকমা জনগোষ্ঠির সেই ছেলে দীপংকরই যখন হয়ে উঠেন সেই বাহিনীর অন্যতম একজন ! বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকান্ডের পর স্তব্ধ বাংলাদেশ দেখল,শুধু একটি লড়াই,একটি প্রতিবাদ প্রতিরোধের,তাও কাদেরিয়া বাহিনীর নেতৃত্বে,যে বাহিনীতে নাম লিখিয়ে পাহাড়ী এক ছেলে আওয়ামীলীগের সাথে যে রক্তের বন্ধন তৈরি করেছিলো ৪৭ বছর আগে,সেই বন্ধন এখনো অটুট ২০২২ সালেও ! মাঝের এক দশক ভারতে পলাতক অভিমানী জীবন শেষে আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে দেশে ফিরে আসা সেই দীপংকরই ধীরলয়ে হয়ে উঠেন পাহাড়ে আওয়ামী রাজনীতির প্রাণপুরুষ ! ৯১ এ নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন পেয়ে বিজয়ী দীপংকরের যে জয়যাত্রা শুরু,তা গত ৩২ বছরে খুব একটা সহজ ছিলোনা। ৯১ ও ৯৬ এর বিজয়ী দীপংকর হোঁচট খান ২০০১ এ। সেই হোঁচটকালিন সময়েই জীবনের অন্য এক রূপ দেখেছেন তিনি। একদিকে সেই সময়কার ক্ষমতাসীন দলের দেশজুড়ে বিপুল অত্যাচার,হামলা মামলা নৃশংসতা আর অন্যদিকে পাহাড়ের রাজনীতিতে নতুন খেলোয়াড় আঞ্চলিক দলগুলোর ক্রমবর্ধমান আধিপত্য প্রস্তার ক্ষমতাহীন দীপংকরকে বিপাকে ফেলে বেশ ! শুধু কি তাই ? ২০০১ থেকে ২০০৬ অবধি সরকার বিরোধী তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলে বিএনপিকে ক্ষমতাহীন করার পর যে নির্বাচনের আয়োজন,নিয়তির কি নির্মম পরিহাস,সেখানেও দল থেকে মনোনয়ন বঞ্চিত হন তিনি,মনোনয়ন দেয়া হয় বিএনপি ছেড়ে এলপিডিপে যোগ দেয়া মনিস্বপন দেওয়ানকে ! কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তে ক্ষুদ্ধ রাঙামাটি আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা বিদ্রোহী প্রার্থী দীপংকরকে মনোনয়ন জমা দিতে বাধ্য করে। যদিও সেই নির্বাচনও পন্ড হয়ে যায়। পরে ২০০৮ সালে ফের মনোনয়ন পান নৌকার,বিজয়ীও হন। পান পার্বত্য মন্ত্রনালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বও। কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনকালিন সরকারের মন্ত্রী থেকেও নির্বাচনে পরাজিত হন দীপংকর,জনসংহতির উষাতন তালুকদারের কাছে। দল ক্ষমতায় থাকায় সেই পরাজয়ের ক্ষত খুব একটা সইতে হয়নি,যদিও প্রতিবেশি জেলার এক নেতা মন্ত্রী হওয়ায়,বুকে যাতনটা ঠিকই সয়ে যেতে হয়েছে ! ৫ বছর পর ২০১৮ সালের নির্বাচনে ফের দলীয় মনোনয়ন পেয়ে বিজয়ী দীপংকর,যদিও মেলেনি মন্ত্রীত্ব। কিন্তু নেতাকর্মীদের কাছে প্রবাদপ্রতীম জনপ্রিয় দীপংকরের তাতেও খুব একটা বেশিকিছু যায় আসেনি। কিছুদিন পর খাদ্য মন্ত্রনালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হয়ে সেই বেদনার ভার হয়ত কিছুটা হলেও লাঘব হয়েছে।
গত তিনদশকে দলে তার একক কর্তৃত্ব এতটাই সুসংহত ছিলো যে, আওয়ামীলীগের যেকোন কর্মসূচীতে খুব নিয়মিত ও জনপ্রিয় শ্লোগান ছিলো-‘ পাহাড়ী বাঙালী একঘর,আমরা সবাই দীপংকর’! তার বিরুদ্ধে সংসদ নির্বাচনে কেউ যেমন প্রার্থী হওয়ার সাহস দেখায়নি,তেমনি দলীয় সম্মেলনগুলোতেও বিনাপ্রশ্নেই সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন তিনি বারবার,বিনা চ্যালেঞ্জেই ! তার বিরুদ্ধে কথা বলবে কিংবা ভিন্নমত জানাবে,এমন ভাবনাই ছিলো দূর ভাবনার বিষয়।
কিন্তু হঠাৎ করেই যেনো বদলে যেতে শুরু করেছে সব। এককালের চেনা মানুষগুলোই সবচে দূরে সরে যেতে শুরু করেছে তার। তার এককালের ঘনিষ্ঠমিত্র নিখিল কুমার চাকমা,যাকে তিনিই দলের মনোনয়নে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে মনোনীত হতে ভূমিকা রেখেছিলেন,সেই নিখিলই আজ তার পথে কাঁটা বিছিয়ে দিয়েছে আসন্ন সম্মেলনে ‘সভাপতি’ পদে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়ে ! কিন্তু কেনো ? আওয়ামীলীগের বিভিন্নস্তরের নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, নিখিলকে দ্বিতীয় মেয়াদে চেয়ারম্যান হতে না দেয়া এবং নিখিলের পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হতে চাওয়ায় সহায়তা না করায়,দুইজনের মধ্যে যে দুরত্ব তৈরি হয়েছে,তাতে আগুনে ঘি ঢেলেছেন একাধিক নির্বাচিত,অনির্বাচিত নেতা ! সাথে প্রগাঢ় পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিবেশী জেলার এক প্রভাবশালী নেতার কথাও বাতাসে চাওড়। সেই সাথে নানা কারণে অকারণে কিংবা স্বার্থের সংঘাতে দীপংকরের কাছে ঠাঁই না মেলা কিছু জেলা,পৌর ও সদর উপজেলার নেতার মেলবন্ধনও মিলেছে নিখিলের সাথে। ফলে এতদিনের রাজনীতের চেনা পথকেই এবার খুব বাঁকাই দেখছেন পাহাড়ের অবিসংবাদিত নেতার তকমা পাওয়া দীপংকর।
যে নেতাদের জন্য বারবার নিজে নানান সিদ্ধান্ত নিয়েছেন,বিতর্কিত হয়েছেন,তারাই আজ তার বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছেন তাকেই ক্ষমতাহীন করে আওয়ামীলীগের সাথে শেকড় উপড়ে ফেলার মিশনে। বিস্ময়ে বিমূঢ় দীপংকর তালুকদার এখন যেনো জীবনের অন্য এক চেহারা দেখছেন। কিছুটা হলেও কি বিব্রত দীপংকর ? দ্বিধাগ্রস্তও কি ? আচরণে অভ্যাসে কাজে পুরোপুরি পেশাদার রাজনীতিবিদ দীপংকরের চলনে বলনে চেহারায় তার কোন ছাপই নেই ! নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টায় হয়ত বেশ কৌশলে আড়ালই করেছেন ভেতরের ঝড়কে চেনা ভঙ্গীতেই ! কিন্তু কতটা পারছেন ? সম্ভবত পুরোটা নয়। চেনা পৃথিবীর চেনা পরিবেশের ন্যুনতম বদলও যখন মানুষকে এলোমেলো করে দেয়,সেখানে একজন নেতার বহু বছরের তিলতিল করে গড়ে উঠা স্বপ্নের প্রাসাদে চির চেনা বন্ধু থেকে হওয়া শত্রুর আগ্রাসী হামলার ভীতি লুকোনো কি এতটাই সহজ ? দীপংকর কি পারবেন,সব ভয়কে জয় করে পুরোনা রূপেই ফিরতে ? কে জানে ! রাজনীতির কূশলী খেলোয়াড় দীপংকরের ‘শেষ চালে’ হয়ত ভেসেই যাবে দৃশ্যত ‘দুর্বল প্রতিপক্ষ’ ! অবশ্য সব খেলাই তো ঝুঁকির,ফলাফল যেকোন কিছুই তো হতে পারে ! পঁচা শামুকেও তো কাটে পা !