আজ ১৭ই মার্চ ২০২০ সাল। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ দিনটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। কেন বিশেষ তাৎপর্যবহ একথা শুধু বাঙালি নয়, তামাম দুনিয়া জানে। এদিন বাংলাদেশ ও বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ পূর্ণ হবে। তাই সাম্প্রতিক বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল বাংলাদেশ ২০২০ সালের ১৭ই মার্চ দিনটিকে মুজিব বর্ষ হিসেবে পালনের ঘোষণা দিয়েছে এবং সে ঘোষণার প্রতি সঙ্গতি রেখে বিশ্বের অনেক দেশ এবং বিশ্বসংস্থাও দিবসটি মুজিববর্ষ হিসেবে পালনের ঘোষণা দিয়েছে। এটি আয়তনের দিক দিয়ে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ছোট্ট একটি দেশের জন্য খুবই মর্যাদাপূর্ণ ঘটনা। এই দিন আমরা ইতিহাসের দিকে নজর দিতে পারি কেন ছোট্ট এই দেশটির স্বাধীনতার মহান স্থপতি জন্মের শতবছর পেরিয়ে আজও বিশ্বময় এত প্রাসঙ্গিক এত সম্মানিত।
বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব তিনি বিশ্বের রাজনৈতিক মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। কিন্তু একাজটি মোটেই সহজ ছিল না। এর জন্য তাঁকে রাজনীতির পাঠ নিতে হয়েছে। মিছিলম সভা সমাবেশ, সংগঠন, বক্তব্য বিবৃতির কৌশল রপ্ত করতে হয়েছে। বই পড়তে হয়েছে, জ্ঞান অর্জন করতে হয়েছে। শাসকগোষ্ঠী ও শোষকের চরিত্র বুঝতে হয়েছে, সমকালীন দেশ, সমাজ ও মানুষের মনস্তত্ত্বকে বুঝতে হয়েছে। রাজনীতির ময়দানে শত্রু -মিত্র চিহ্নিত করতে হয়েছে। প্রাণাধিক প্রিয় বাবা-মার স্নেহ আদর থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছে। স্ত্রী-পুত্র পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন একাকী জীবন যাপন করতে হয়েছে। শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়ে তাঁকে বারংবার জেলখানার অন্ধকার প্রকোষ্ঠে সীমাহীন জুলুম নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। এসবের উর্ধ্বে তাঁকে তৈরি করতে হয়েছে বাংলার গরিব দুঃখী নিপীড়িত বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায় ও মুক্তির জন্য একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অনবদ্য সংগ্রামের ছক। তাঁর রচিত ছক ও দিক নির্দেশনা অনুসরণ করেই বাঙালি পেয়েছে স্বাধীনতা। তাই তো তিনি এত মহান। এখনো এত স্মরণীয় ও প্রাসঙ্গিক। কিন্তু নতুন প্রজন্ম কী জানে কে সেই বঙ্গবন্ধু? মা-বাবার নিকট যিনি ছিলেন চিরআদরের ‘খোকা’; ভাইবোন ও পাড়াপ্রতিবেশীর কাছে ছিলেন ‘মিয়াভাই’; রাজনৈতিক সহচরদের কাছে মুজিব ভাই; পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কাছে ছিলেন ‘দ্য মোস্ট মিলিট্যান্ট মেম্বার অব আওয়ামী মুসলিম লীগ’ এবং বাংলাদেশের আপামর ছাত্রজনতার নিকট বঙ্গবন্ধু আর বিবিসির জরিপে নির্বাচিত হয়েছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। একজন মানুষের মাত্র ৫৫ বছরের আয়ুস্কালে এত পরিচয়বৈচিত্র্য কী করে সম্ভব হলো? কী এর রহস্য? বঙ্গবন্ধুর রচনা সম্ভার থেকেই তাঁর জবাব মেলে। তিনি তাঁর বাবার উপদেশ মেনেই জীবনের লক্ষ্য স্থির করেছেন। তাঁর সাদাসিধে বাবা একদা তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘ংরহপবৎরঃু ড়ভ ঢ়ঁৎঢ়ড়ংব ধহফ যড়হবংঃু ড়ভ ঢ়ঁৎঢ়ড়ংব.’ থাকলে জীবনে পরাজিত হবে না”। বঙ্গবন্ধু বাবার এই উপদেশ জীবনে কোনোদিন ভুলেননি। অন্যদিকে তিনি মনে করতেন, ‘এৎবধঃ ঃযরহমং ধৎব ধপযরবাবফ ঃযৎড়ঁময মৎবধঃ ংধপৎরভরপবং. অর্থাৎ ‘মহৎ অর্জনসমূহ অর্জিত হয় মহাত্যাগের মধ্যদিয়ে।’ বঙ্গবন্ধুর সমগ্র সংগ্রামী জীবনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এদুটি নীতিরই প্রতিফলন দেখা যায়।
মধুমতীর শাখা নদাী বাইগার নদীর তীর ঘেঁষে ছবির মতো সাজানো সুন্দর একটি গ্রাম। সে গ্রামটির নাম টুঙ্গিপাড়া। এই টুঙ্গিপাড়ায় মধ্যবিত্ত শেখ পরিবার বসতি গড়ে তোলে আঠারো শতকে। শেখ আবদুল হামিদের নির্মিত টিনের চৌচালা ঘরে সংসার পাতেন তারই ছেলে শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুন। ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ শেখ লুৎফর রহমানের ঘর আলো করে ভূমিষ্ট হয় প্রথম পুত্রধন। খুশিতে গদগদ পুরো পরিবার। আকিকার সময় সায়েরা খাতুনের বাবা মানে বঙ্গবন্ধুর নানা তাঁর নাতির নাম রাখলেন শেখ মুজিবুর রহমান। শৈশব ও কৈশরে টুঙ্গিপাড়ার গিমাডাঙ্গা স্কুল ও গোপালগঞ্জের পাবলিক স্কুলে আনুষ্ঠানিক পড়াশুনা শুরু হয়। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য চলে যান তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের প্রধান শহর কলকাতায়। ইসলামিয়া কলেজ (যা এখন মওলানা আজাদ কলেজ) এর বেকার হোস্টেলে থেকেই বি.এ. পাস করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। বঙ্গবন্ধুর কথায়, ‘‘আমি ভাবতাম, পাকিস্তান কায়েম হয়েছে, আর চিন্তা কি? এখন ঢাকায় যেয়ে ল ক্লাসে ভর্তি হয়ে কিছুদিন মন দিয়ে লেখাপড়া করা যাবে। …. আমি ঢাকায় এলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি, আইন পড়ব। বই পুস্তক কিছু কিনলাম।’।
বঙ্গবন্ধু যখন মিশন স্কুলের ছাত্র তখন বাংলাদেশে এ. কে ফজলুল হক সাহেবের কৃষক প্রজা পার্টির জয়জয়কার অবস্থা। কিন্তু মুসলিম লীগ অতটা গেড়ে বসতে পারেনি। সময়টা ১৯৩৮ সাল। এসময় প্রজানেতা বাংলার প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক ও শ্রমমন্ত্রী মুসলিম লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পূর্ব বাংলার গোপালগঞ্জ পরিদর্শনে আসেন এবং তরুণ ছাত্র শেখ মুজিবের সাথে সোহরাওয়ার্দীর সাক্ষাৎ ঘটে। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনীতিতে আসার ঘটনা সবিস্তারে তুলে ধরেছেন। তার চুম্বক অংশ এমন: “হক সাহেব ও শহীদ সাহেব এলেন, সভা হল। … হক সাহেব পাবলিক হল দেকতে গেলেন। আর শহীদ সাহেব গেলেন মিশন স্কুল দেখতে । আমি মিশন স্কুলের ছাত্র। তাই তাঁকে সম্বর্ধনা দিলাম। তিনি স্কুল পরিদর্শন করে হাঁটতে হাঁটতে লঞ্চের দিকে চললেন, আমিও সাথে সাথে চললাম। আমার দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার নাম এবং বাড়ি কোথায়। … তিনি আমাকে ডেকে নিলেন খুব কাছে, আদর করলেন এবং বললেন, ‘‘তোমাদের এখানে মুসলিম লীগ করা হয় নাই” বললাম, ‘‘কোনো প্রতিষ্ঠান নই, মুসলিম ছাত্রলীগও নাই।” ১৯৩৯ সালে কলকাতা বেড়াতে যাই। শহীদ সাহেবের সাথে দেখা করি। … শহীদ সাহেবকে বললাম, গোপালগঞ্জে মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করব এবং মুসলিম লীগও গঠন করব। খন্দকার শামসুদ্দীন সাহেব এমএলএ তখন মুসলিম লীগে যোগদান করেছেন। তিনি সভাপতি হলেন ছাত্রলীগের। আমি হলাম সম্পাদক। মুসলিম লীগ গঠন হল। …আমি আস্তে আস্তে রাজনীতির মধ্যে প্রবেশ করলাম।” সেই যে রাজনীতিতে যোগদান করলেন আর পিছু হটেন নি। শুধু সামনের দিকে চলা।
১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের পর থেকে পাকিস্তান আন্দোলন তুঙ্গে। এ আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন সক্রিয় কর্মী। প্রচুর পরিশ্রম করছেন। বই পড়ছেন। ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস পড়ছেন। তাঁর ভরসা হবীবুল্লাহ বাহার এর লেখা ‘পাকিস্তান’ আর মুজিবুর রহমান খাঁ সাহেবের লিখিত ‘পাকিস্তান’ বইদুটি। একদা ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগানে মুখর ছিলেন। শুধু তাই নয় ভারতের মানচিত্র, তৎকালীন জনপ্রিয় দৈনিক আজাদের কাটিং সবসময় তাঁর ব্যাগের ভিতর থাকত। জনগণকে পাকিস্তান কেন দরকার বোঝাতেন। তিনি আত্মজীবনীর এক জায়গায় লিখছেন, ‘তখন রাজনীতি শুরু করেছি ভীষণভাবে। সভা করি, বক্তৃতা করি। খেলার দিকে আর নজর নাই। শুধু মুসলিম লীগ আর ছাত্রলীগ। পাকিস্তান আনতেই হবে, নতুবা মুসলমানদের বাঁচার উপায় নাই।’ এমন গভীর উচ্চাশা নিয়েই তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে ওতপ্রোতভাবেই জড়িয়ে পড়েন। শেখ মুজিবদের মতো নিখাদ দেশপ্রেমিক তরুণদের জন্যই পাকিস্তান কায়েম হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান গঠিত হওয়ার পর বোঝা গেল কাক্সিক্ষত পাকিস্তান আর সৃষ্ট পাকিস্তানের মধ্যে আসমান জমিন ফারাক। ফলে বঙ্গবন্ধুর মতো তরুণদের মতো পশ্চিম পাকিস্তানিদের বেঈমানি মেনে নেয়া ছিল ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক। সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তির মানসেই তিনি নতুন ধারার রাজনীতি শুরু করেছেন।
১৯৪৭ সালে ১৪ আগস্ট পাকিস্তান জন্ম নিল। কিন্তু যারা পাকিস্তান ও পূর্ব বাংলা সরকার গঠন করলেন তাদের নীতি ও কর্মপন্থা দেখে পূর্ব বাংলার ত্যাগী নেতাদের মোহভঙ্গ হল। মুসলিম লীগ নেতারা কোটারি করে সোহরাওয়ার্দী ও ফজলুল হক ও আবুল হাশিম প্রমুখ জননেতাদের ক্ষমতার বলয় তথা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব থেকে কূটকৌশলে দূরে সরিয়ে রাখল। মুসলিম লীগ সরকার বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন শুরু করে দিল। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে সংগ্রামরত ছাত্রদের নামে পঞ্চমবাহিনী, কমিউনিস্ট, ভারতের দালাল, রাষ্ট্রদ্রোহী প্রভৃতি বদনাম জুড়ে দিলো। জেলে বন্দি করে পাশবিক নির্যাতন শুরু করে দিল। পাখির মতো গুলি করে গরিব মানুষ হত্যা করতে লাগল। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণহীন। জমিদারি উচ্ছেদের কথা থাকলেও সেটা না করে উল্টো জমিদারদের জন্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৬০ কোটি টাকা দেওয়ার বন্দোবস্ত হল। এসব দেখে ত্যাগী নেতারা হতাশ হলেন। মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হলেন। বঙ্গবন্ধু আক্ষেপ করে লিখেছেন, ‘আমার ভীষণ জেদ হয়েছে মুসলিম লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে। যে পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলাম, এখন দেখি তার উল্টা হয়েছে। এর একটা পরিবর্তন দরকার। জনগণ আমাদের জানত এবং আমাদের কাছেই প্রশ্ন করত। স্বাধীন হয়েছে দেশ, তবু মানুষের দুঃখ কষ্ট দূর হবে না কেন? দুনীর্তি বেড়ে গেছে, খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। বিনা বিচারে রাজনৈতিক কর্মীদের জেলে বন্ধ করে রাখা হচ্ছে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে মুসলিম লীগ নেতারা মানবে না। পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্প কারখানা গড়া শুরু হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের দিকে নজর দেতওয়া হচ্ছে না। রাজধানী করাচি। সব কিছুই পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব বাংলায় কিছু নাই।” এ বোধ তাঁকে বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর অদম্য সংগ্রামে আত্মপ্রত্যয়ী করে তোলে।
বঙ্গবন্ধু জীবনভর সংগঠন তৈরি করেছেন, পরিচালনা করেছেন। পুর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, আওয়ামী মুসলিম লীগ, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ। এসব দলের সাথে মিশে আছে বঙ্গবন্ধুর সাংগঠনিক প্রতিভার ছাপ। সংগঠন করার জন্য, সংগঠনকে জনগণের কাছে জনপ্রিয় করার জন্য তিনি মহাত্মা গান্ধী ও নেহরুর মতো সারা বাংলা চষে বেড়িয়েছেন। মহাত্মা গান্ধীর মতে, জননেতা হওয়ার পূর্বশত হলো স্বদেশভ্রমণ এবং দেশের মানুষকে জানা ও বাস্তব অবস্থা বোঝা। সুতরাং পাবনা, রংপুর, সিলেট, বরিশাল, চট্টগ্রাম হেন কোনো জেলা বা মহকুমা নেই যেখানে বঙ্গবন্ধুর পদ পড়েনি। তিনি লিখেছেন, ‘ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠান গঠন করার সাথে সাথে বিরাট সাড়া পাওয়া গেল ছাত্রদের মধ্যে। এক মাসের ভিতর আমি প্রায় সকল জেলাতেই কমিটি করতে সক্ষম হলাম।’ লালবাগের ১৫০ মোগলটুলি বঙ্গবন্ধুর শয়নে বিচরণে কর্মমুখর থাকতো। কারণ সেটাই ছিল তার পার্টি অফিস। মুসলিম লীগের খবরদারি ও জুলমবাজি বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দল গঠন প্রসঙ্গে তাঁর অভিমত ছিল, ‘বিরোধী দল সৃষ্টি করতে না পারলে এ দেশে একনায়কত্ব চলবে।’ ১৯৪৯ সালে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগে কমিটিতে তিনি যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে নতুন ধারার রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। তাঁর লিখিত আমার দেখা নয়াচীন গ্রন্থ থেকে তাঁর দলীয় রাজনৈতিক আদর্শ সম্পর্কে জানা যায়, ‘আমাদের স্বতন্ত্র দল আছে, … আমাদের প্রোগ্রাম আছে, ম্যানিফেস্টো আছে। আমাদের দলের নেতা হোসেন শহীদ সোহরায়ার্দী ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। এঁরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন। আইন করে কারও কণ্ঠরোধ করার উদ্দেশ্য আমাদের দলের নাই। আমরা দেশের সম্পদ এবং ন্যায়ভিত্তিক আদর্শ দিয়ে দেশ গড়তে চাই। ভাড়া করে কোনো আদর্শ আমরা গ্রহণ করতে প্রস্তুত নই। আবার মিছামিছি কোনো আদর্শকে লোকের চোখে হেয় করতেও চাইনা। মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতায় আমরা বিশ্বাস করি।”
পাকিস্তান আন্দোলনের পর স্বাধীন পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর সক্রিয় রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু হয় ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। তিনি ছিলেন এর উদ্যেক্তা, সংগঠক, পরিচালক ও প্রথম কারাভোগী ছাত্রনেতা। দেশভাগের পর জেলখানায় বসে আন্দোলনের অংশ হিসেবে কোনো নেতার অনশনের দৃষ্টান্ত তিনিই প্রথম স্থাপন করেন। তিনি বাংলাভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির সাধক আব্বাসউদ্দীনের ভক্ত ছিলেন। সুতরাং বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করাটাকে তিনি দায়িত্ব ও কর্তব্য হিসেবে নিয়েছিলেন। ছাত্রদের প্রতিবাদে ও আত্মবলিদানের ফলে ভাষা আন্দোলন প্রথম গণআন্দোলনে পরিণত হয়। উল্লেখ্য যে, এসময় ১৯৫২ সালে তিনি পিস কনফারেন্সে যোগদানের উদ্দেশ্যে চীন সফর করেন। এসফরে নয়াচীনের জননেতা মাও সেতুংয়ের সাক্ষাতলাভ তাঁর রাজনৈতিক জীবন গঠনে বড় প্রভাব ফেলেছে। মাত্র ২০ বছরের মাথায় তিনিও মাও সেতুংয়ের মতো জনপ্রিয় জননেতায় পরিণত হন। অভিষিক্ত হন বঙ্গবন্ধু উপাধিতে। যাহোক, ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগকে ঠেকানোর জন্য যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। যুক্তফ্রন্টকে বিজয়ী করতে কঠোর পরিশ্রম করেন এবং ২১ দফার পক্ষে গণরায়ের মাধ্যমে বাংলার রাজনীতিতে মুসলিম লীগকে অপাঙতেয় করে ছাড়েন । তিনি কিছু সময়ের জন্য সমবায় ও শ্রম মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন। স্বাধীনতা যার লক্ষ্য মন্ত্রীত্ব তার কাছে তুচ্ছ ব্যাপার। তিনি ১৯৫৭ সালে পদত্যাগ করেন। দল গোছানোর কাজে নিমগ্ন হয়ে পড়েন। এর মধ্যে পাকিস্তানে ঘটে যায় সামরিক অভ্যুত্থান। আইয়ুব খান গেড়ে বসেন ক্ষমতা মসনদে। শুরু হয় রাজনীতিবিদদের উপর জুলম, নির্যাতন। এর মধ্যেই ১৯৬৬ সালে তিনি ছয়দফা ঘোষণা করে জনমত গঠনের জন্য পুরো দেশ সফর করেন। এবং তাঁর জ্বালাময়ী বাগ্মীতায় জনগণের কণ্ঠস্বরে পরিণত হন। তিনি ছয় দফাকে বাঙালির বাঁচার দাবি ও মুক্তির সনদ হিসেবে ঘোষণা করেন এবং এর পক্ষে জনমত গঠনে সারাদেশ সফর শুরু করেন। ছয় দফার ব্যাপারে তিনি ছিলেন আগাগোড়া আপোসহীন। বিরোধী ও সুবিধাবাধীদের তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘ছয়দফা রাজনৈতিক দরকষাকষির কোনো ব্যাপার নহে, ইহার সহিত জড়িত রহিয়াছে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষের জীবন মরণ প্রশ্ন।’ এজন্য তিনি জুনমাসে আবার কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। জেলখানার ভিতরেই তিনি ছয়দফার আন্দোলনের উত্তাপ অনুভব করেন। কারাগারের রোজনামচায় তিনি লিখছেন, ‘ছয়দফা যে পূর্ব বাংলার জনগণের প্রাণের প্রাণের দাবি- পশ্চিমা উপনিবেশবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল পশ্চিম পাকিস্তানের শোষকশ্রেণি যে আর পূর্ব বাংলার নির্যাতিত গরীব জনসাধারণকে শোষণ বেশি দিন করতে পারবে না, সে কথা আমি এবার জেলে এসেই বুঝতে পেরেছি। বিশেষ করে ৭ই জুনের যে প্রতিবাদে বাংলার গ্রামে গঞ্জে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ফেটে পড়েছে, কোনো শাসকের চক্ষুরাঙানি তাদের দমাতে পারবে না।’ ১৯৭০ সালে জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর ছয়দফার প্রতি বাংলার জনগণের রায় ও তার ফলে নিরঙ্কুশ বিজয়ই তার জলন্ত প্রমাণ।
পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পর থেকেই বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাকি শাসকগোষ্ঠীর প্রথম ও একমাত্র টার্গেট। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু যে ভাষা আন্দোলন থেকে যুক্তফ্রন্ট, স্বাধিকার থেকে স্বায়ত্তশাসন, স্বায়ত্তশাসন স্বাধীনতা ও জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের পথরেখা তৈরি করেছেন সেটা মোটেই নিষ্কন্টক ছিল না। পাকিস্তানি জালেম সরকার তো ছিলই, আরও ছিল ঘরের শত্রু বিভীষণরা। যেমন- ছয়দফা ঘোষণার পর ভাসানীও বিরোধিতা করেছিলেন। প্রত্যেকটা আন্দোলন কর্মসূচির সময় পাকিস্তানি গোয়েন্দা বাহিনী তাঁর উপর কড়া নজর রাখত। পাকিস্তানের ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ প্রতিদিন প্রতিমূর্হতে তাঁর কর্মকাণ্ড, গতিবিধি, বক্তব্য বিবৃতি পর্যবেক্ষণ ও রিপোর্ট করত। এধরনের ঘটনা অন্য কোনো দেশের কোনো নেতা বা রাজনীতিকের জীবনে ঘটেছে কিনা গবেষণা সাপেক্ষ। যার প্রমাণ তার নামে চালুকরা একটি ব্যক্তিগত ফাইল। মুক্ত ও বন্দিমুজিবের প্রতি পদক্ষেপে শাসকগোষ্ঠী তথ্য সংগ্রহ করতো। পুলিশের খাতায় তার ফাইল নম্বর ছিল পি.এফ. বা পার্সন্যাল ফাইল নং ৬০৬-৪৮। এসব ফাইলে সংগৃহীত তথ্যাবলি এখন দেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের অসামান্য দলিল। শুধুমাত্র কড়া নজর দারি করেই আইয়ুব মোনায়েম চক্র ক্ষান্ত থাকেনি। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সশ্রস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে দেশ বিচ্ছিন্ন করার কথিত অভিযোগ উত্থাপন করে যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত। এখানে বঙ্গবন্ধু পহেলা নম্বর আসামী। সেনানিবাসের ভেতর তাঁকে লোক দেখানো বিচারে ফাঁসিতে ঝুলানোর পাঁয়তারা চলে। গণঅভ্যুত্থান করে বাঙালি তাদের প্রিয় নেতাকে মুক্ত করে আনে। ফলে বঙ্গবন্ধুকে দমানো যায়নি। কোনো সময় তিনি পালিয়ে যাননি। পালানোর রাজনীতিতে তিনি বিশ্বাস করতেন না। ২৫ মার্চের যখন পাক সেনারা ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যায় মেমে ওঠেছিল বঙ্গবন্ধু তখনো পালাননি। তিনি জানতেন তিলি আত্মগোপনে গেলে টিক্কাখান তাঁর খোঁজে সারা শহর দেশ তন্ন তন্ন করে চষে বেড়াবে আর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে। তিনি নিজের জীবনের বিনিময়ে দেশের মানুষকে সুরক্ষা দিয়েছেন। ফলে আইয়ুব মোনেম চক্র দশ বছর ক্ষমতা মসনদে থেকেও দেশের শত্রু বনে গেলেন; গণঅভ্যুত্থানে ছিটকে পড়লেন সাধের গদি থেকে। আর দশটি বছর জেল জুলুম অত্যাচার নিবর্তন সহ্য করে বাংলার মেহনতী মানুষের অধিকারের কথা বলে জনতার চোখে শেখ মুজিব পরিগণিত হলেন বাংলার বন্ধু বা ‘বঙ্গবন্ধু’তে।
বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবনের একটি বড় অধ্যায় জুড়ে আসে তারা কারাবন্দি জীবন। এক জীবনে এত দীর্ঘকাল কারাবাস খুব কম রাজনীতিবিদের জীবনে দেখা গেছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন বেকার বসে কাটেনি। তিনি প্রচুর বই পড়েছেন। রবীন্দ্র ,নজরুল , রাসেল, বার্নাড শ, শেলী, কীটস, টলস্তয় কীনা পড়েছেন তিনি। তিনি শুধু একজন মন্ময় পাঠক ছিলেন না। লিখেছেন প্রচুর। তাঁর লেখনিসমূহ এখন আমাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস রচনার অমূল্য উপাদান। অপূর্ব তাঁর লেখনি। বেগম মুজিবের অনুপ্রেরণায় ও তাগাদায় কারাগারে বসে তিনি রচনা করেছেন শ্রেষ্ঠ ভ্রমণ কাহিনী ‘আমার দেখা নয়াচীন’। অত্যন্ত সুখপাঠ্য আত্মজীবনী ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। ১৯৪৮ সালে শুরু হয় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ছাত্রসমাজের আন্দোলন। বঙ্গবন্ধু সেবছর ১১ মার্চ গ্রেফতার হয়ে কারাগারে অন্তরীণ হন। ১৫ই মার্চ মুক্তিলাভ করেন। এভাবে কোনো সময় এক সপ্তাহ কোনো সময় মাস বছর তিনি বারবার গ্রেফতার হয়েছেন। বিনা বিচারে আটক হয়ে জেল খেটেছেন। সশ্রম কারাদণ্ড ও রাজবন্দির কারাভোগ সব তাঁর জীবনে জুটে ছিল। তিনি ব্যঙ্গ করে নয়াচীন গ্রন্থে লিখেছেন, ‘আমার আবার পরিচয়? পথে পথে ঘুরে বেড়াই, বকতৃতা করে বেড়াই। আর মাঝে মাঝে সরকারের দয়ায় জেলখানায় পড়ে খোদা ও রসুলে নাম নেবার সুযোগ পাই। এইতো আমার পরিচয়।’ অন্যদিকে তার কারাগারের রোজনামচা তথা জেলখানার নোটখাতা লেখার একটা শিরোনাম রেখেছেন, ‘থালা বাটি কম্বল /জেলখানার সম্বল।’ পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পর তিনি যখন ঘন ঘন কারাগারে বন্দি থাকতেন তখন তার আম্মা আক্ষেপ করে তাকে সওয়াল করছেন, ‘বাবা তুই তো পাকিস্তান পাকিস্তান করে চিৎকার করেছিস, কত টাকা নিয়ে খরচ করেছিসÑ এদেশের মানুষ তো তোর কাছ থেকেই পাকিস্তানের নাম শুনেছিল, আজ তোকেই সেই পাকিস্তানের জেলে কেন নেয়? সত্যিই তো। পাকিস্তান নামে ভারতবর্ষে কোনো ভূখণ্ড ছিল না। পূর্ব বাংলার মানুষ এতসব জানতো না। ওরা নেতা বলতে জানতো ফজলুল হক সাহেবের কথা আর দল মানে প্রজা পার্টিকে। সেই মানুষের নিকট তিনি পাকিস্তান আন্দোলনকে জনপ্রিয় করেছেন। মুসলিম লীগ চিনিয়েছেন। অথচ পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পর সেই তিনিই কিনা মাবাবার øেহবাৎসল্য ছেড়ে কারাগারের অন্ধকার কুঠুরিতে দিনকাটাচ্ছেন। পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে এত ভয় পেতো যে তাকে কারাগারে রাখতে পারলেই দেশরক্ষা হয়েছে ভাবতো। এদিকে জেলখানায় অন্তরীণ থাকতে থাকতে স্বীয়পুত্রধন তাকে চিনতে পারছে না। এর চেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা আর কীইবা হতে পারে। একদিন এক জেল থেকে আরেক জেলে গমনের সময় স্বজনদের সাক্ষাৎ পান বঙ্গবন্ধু। সেখানে: ‘‘হাচিনা আমার গলা ধরল আর ছাড়তে চায় না। কামাল আমার দিকে চেয়ে আছে, আমাকে চেনেও না আর বুঝতে পারে না, আমি কে?’’ Ñ এর চেয়ে ত্যাগের কথা আর কী হতে পারে। শেখ হাসিনার মতে, মনের জোর ও মানুষের প্রতি ভালোবাসার কারণেই তাঁকে এত কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা আল্লাহ দিয়েছেন।… এত আত্মত্যাগ তিনি করেছেন বলেই তো আজ পৃথিবীর বুকে বাঙালি জাতি একটা রাষ্ট্র পেয়েছে। এই তুলনাহীন অর্জনের জন্যেই তিনি আজ জাতির পিতা।” বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে দুর্বিষহ কারাজীবন ছিল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নয়মাস পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দিত্বকালে। কারাগারের প্রকোষ্ঠে অন্ধকারের একাকীত্ব জীবন কাটিয়েছেন মৃত্যু উপত্যকার সমুখে দাঁিড়য়ে। কিন্তু তিনি ছিলেন নির্ভিক। অকুতোভয়। কোনো ভয়, প্রলোভন তাঁকে প্রলুদ্ধ করতে পারেনি। পারেনি সংগ্রামের আদর্শ থেকে চুল পরিমাণ বিচ্যুত করতে। বাংলার মানুষের জন্য এ সংগ্রাম ছিল তার সর্ম্পূর্ণ একার।
১৯৭১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলেন। এ নির্বাাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা না-হস্তান্তর করার এই ঘৃণ্য চক্রান্ত বুঝতে আর বাকি থাকল না। ১ মার্চেই বেজে গেল পাকিস্তানের মৃত্যু ঘণ্টা। ১ মার্চ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ প্রতিবাদ সভা করলো। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘এটা বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দেয়া হবে না।’ তিনি ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ থেকে সারা প্রদেশে হরতাল ও অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। সারা পূর্ব বাংলা ক্ষোভে বিক্ষোভে ফেটে পড়লো। জয় বাংলা স্লোগানে বাংলার জনপদ মুখরিত হলো। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই সবকিছু চলতে লাগলো। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম যথার্থই বলেছেন যে ১ মার্চ থেকেই একটি ডি-ফ্যাক্টো ও ডি-জুরে বাংলাদেশ সরকার কিন্তু হয়েছিল। আর সেই শাসনকাঠামোতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিদের্শনা দিচ্ছিলেন এবং সে অনুযায়ী সরকার চলছিল। ৩ মার্চ ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতার হিসেবে আখ্যা দিল। সেদিন আহুত পল্টন ময়দানের ছাত্রলীগের জনসভায় উল্কার মতো মুজিব দর্শন দিলেন। তিনি বললেন, ‘অহিংস অসহযোগ আন্দোলন চলমান জারি থাকবে, যা বলার তা তিনি বলবেন ৭ মার্চের জনসভায়। অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ঐতিহাসিক ৭ ই মার্চ। স্থান রেসকোর্স ময়দান। সমাবেশে নানা বয়সী, পেশার জনতার ঢল। রাজনীতির কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি।
বঙ্গবন্ধুর ৭ ই মার্চের ভাষণ এখন বিশ্ব মেধা সম্পদ। বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক জীবনে অগণিত ভাষণ দিয়েছেন। কিন্তু প্রেক্ষিত, ক্ষণ, ইতিহাসবিচার, জনতার প্রত্যাশা ও প্রতিক্রিয়া বিবেচনায় বিষয়বস্তু ও দিকনির্দেশনা, শাসকগোষ্ঠীর কঠোর নজরদারি বিবেচনায় ভাষণের শব্দ ও বাক্যচয়ন, সময় সংযম ও পরিমিতিবোধ এবং পরবর্তী তাৎপর্য সর্বদিক বিবেচনায় এ ভাষণটি ছিল অনবদ্য ভাষণ যা বাঙালির মনে চিরস্থায়ী দাগ কেটে গেছে। এ ভাষণ দিয়ে তিনি বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছেন। তাঁর বজ্রকণ্ঠে সেদিন ধ্বনিত হয়েছিল, ‘এরপর যদি একটা গুলি চলে , এরপর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়Ñ তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে, সব কিছু আমি যদি হুকুম দিবার না-ও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।… আমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। রক্ত যখন দিয়েছি, আর ও রক্ত দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ।’ এভাবে স্বাধীনতা ও মুক্তির নিশানা লাভের জন্য দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। সর্বশেষে ২৬ মার্চের প্রথম প্রথমে আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা তাও বঙ্গবন্ধুর কলম থেকেই আসল। ফলে জাতি পেয়েছিল দিশা। সমগ্র জাতি একতাবদ্ধ হয়ে পাক হানাদারদেরকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছিল।
পাকিস্তানের কারাগার মুক্তিলাভের পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশের মাটিতে পা রাখেন বঙ্গবন্ধু। সেদিন রেসকোর্স ময়দানের সংবর্ধনা সভায় তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আজ আমার জীবনের সাধ পূর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।’… বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে, খেয়ে-পরে সুখে থাকবে, এটাই ছিল আমার সাধনা।”Ñ একথা থেকে কারো বুঝার বাকি থাকেনা তাঁর জীবনের লক্ষ্য কী ছিল। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রাদর্শও প্রতিফলিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সেদিনের ভাষণে। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন, ‘‘আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই যে বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মীয়ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।”
এই হলো মহামানবের মহান কথা। কিন্তু মহাপুরুষের চিরবিদায়ের ঘটনাটি ছিল অনভিপ্রেত, মর্মন্তুদ বেঘনাহত। তাঁর পরম মমতা তিলে তিলে গড়া সাধের বাংলা যখন শত বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখনই জাতির কিছু কুলাঙ্গার দিকভ্রষ্ট সেনাসদস্য তাঁকে তাঁর স্বগৃহে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে। সমগ্র জাতিকে শোকে মুহ্যমান করে দিয়ে মহাপুরুষের ট্র্যাজিক জীবনাবসান ঘটে।
উপরের আলোচনায় এটা স্পষ্ট যে বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালির জন্য একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা। এ স্বপ্ন তাঁকে প্রতিবাদমুখর করে তুলেছে। করে তুলেছে আত্মপ্রত্যয়ী। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন পূরণের জন্য তিনি ধাপে ধাপে ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছেন, প্রস্তুত করেছেন জনতাকে। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী স্যারের কথায়, ‘ পরম নিন্দুকও জানে এই ব্যক্তি সেদিনের শেক মুজিব, এক স্বপ্নগ্রস্ত পাগলের মতো বাঙালীর মুক্তির সোনার হরিণের পিছনে ছুটেছেন। ঘর-সংসার ভুলে, আরাম বিশ্রাম ভুলে, পুরস্কার প্রলোভন তুচ্ছ করে, নিজের প্রাণকে জিম্মি রেখে ছুটেছেন। এক অদম্য প্রেরণা তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে ফিরেছে। যতো দিন গিয়েছে, তাঁর লক্ষ্য ততো স্পষ্ট হয়েছে, তাঁর প্রত্য ততো দৃঢ় হয়েছে। শুধু তাই নয়, যখন বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে, একটি অসম্ভব স্বপ্ন থেকে একটি বাস্তবে, ততোদিনে তাঁর ভাবনাও লাভ করেছে এক ব্যাপকতা। ততোদিনে তিনি সামাজিক ন্যায় ও সমতাভিত্তিক এক গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রূপরেখা এঁকে ফেলেছেন তাঁর বিশাল হৃদয়ে।’’ এই হলো আমাদের বঙ্গবন্ধু, সোনার বাংলার স্বপ্নচারী মহাপুরুষ। পাকিস্তানি শাসকচত্রও হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি। একের পর এক ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেছে। চালিয়েছে অত্যাচার-নির্যাতনের স্টিম রোলার। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সাংগঠনিক শক্তির কাছে, সংগ্রামী প্রতিভার কাছে, রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কাছে, দূরদর্শিতার কাছে শাসকগোষ্ঠী চরমভাবে পরাজিত হয়েছে। তাঁরই অনুপস্থিতিতেও জনতা বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। তাই তো তিনি এক অজেয়-অবিস্মরণীয়- আত্মপ্রত্যয়ী রাষ্ট্রগুরু। শেষ করবো মুজিব বর্ষে তাঁর প্রতি জানাই বিনম্র সালাম ও শ্রদ্ধা।
[লেখক: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক] সহায়ক গ্রন্থমালা:১. শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ঢাকা: দ্য ইউনিভার্সিটি প্রেস লি. ২০১৬ (প্রথম প্রকাশ ২০১২)
২. শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রোজনামচা, ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ২০১৭।
৩. শেখ মুজিবুর রহমান, আমার দেখা নয়াচীন, ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ২০২০।
৪. শেখ হাসিনা (সম্পাদিত), সিক্রেটস ডকুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ভলিয়্যুম ১-২ ঢাকা: হাক্কানি পাবলিশার্স, ২০১৮ ও ২০১৯।
৫. শেখ হাসিনা, “শেখ মুজিব আমার পিতা”মিজানুর রহমান সজল ও জাফর সাদিক সম্পাদিত জয়তু মুজিব ঢাকা: অনুপম প্রকাশনী, ২০১৪।
৬. স্বদেশপ্রত্যাবর্তন, পনেরই আগস্ট ও ৭ই মার্চের ওপর দৈনিক প্রথম আলোর প্রকাশিত বিশেষ ক্রোড়পত্র
৭. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ, ঢাকা:আগামী প্রকাশনী, ২০০৫ (প্রথম প্রকাশ ১৯৯৫)