আরমান খান, লংগদু ॥
হাড়িতে রান্না হচ্ছে কোরবানির গরুর মাংস, ঘরের দুয়ারে বসে বিড়িতে সুখ টান দিচ্ছেন আব্দুল হাকিম (৭০)। আপাতদৃষ্টিতে দৃশ্যটি চমৎকার মনে হলেও ঘটনা কিন্তু তা নয়। আব্দুল হাকিম নামের এই বৃদ্ধের ঘর নাই। গৃহহীন আব্দুল হাকিম ব্রিজের নিচে টিনের বেড়া দিয়ে ১০ বছরের এক শিশুকে নিয়ে বসবাস করেন। সেই ঘরেই মানুষের দেয়া কোরবানীর মাংস রান্না করছিল আব্দুল হাকিম। রাঙামাটির লংগদু উপজেলার কালাপাকুজ্যা ইউনিয়নের শিবিরবাজার এলাকায় ব্রিজের নিচে গত ছয় মাস ধরে মেয়ে মিনারাকে নিয়ে বসবাস করেন এই বৃদ্ধ। এর আগে কখনো এ বাড়ির বারান্দায় কখনো ও বাড়ির পরিত্যক্ত ঘরে থেকেছেন দীর্ঘ সময়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখাযায়, কালাপাকুজ্যা ইউনিয়নের শিবির বাজারের কাছে এলজিইডি নির্মিত একটি সেতুর নিচের পিলার ঘিরে টিনের বেড়া। সেখানে ১০/১২ ফুটের একটি রুম বানিয়ে বাবা মেয়ের বসবাস। রুমের একপাশে একটা চৌকি অন্যপাশে রান্নার জন্য একটা মাটির চুলা বসিয়েছেন আব্দুল হাকিম। রুমের চারপাশে দড়ি বেঁধে তাতে নিজেদের কাপড় ঝুলিয়ে রেখেছেন। একটা রুমের মধ্যেই থাকা খাওয়া আর রান্নার সব কাজ করতে হয় আব্দুল হাকিমের।
সম্প্রতি বৃদ্ধ আব্দুল হাকিমের সাথে আলাপ করলে তিনি জানান, একসময় ঘরবাড়ি, জমিজমা, স্ত্রী-সন্তান, সংসার সবই ছিল আমার। ৩০ বছর আগে প্রথম স্ত্রীর সাথে বিচ্ছেদ হয়। সেই সংসারে ২ ছেলে ও এক মেয়ে আছে। তারা সবাই বিয়ে করে নিজ নিজ সংসার করছে। এরপর ১০ বছর আগে দ্বিতীয় স্ত্রী মারা গেলে জমিজমা সব কিছু বিক্রি করে জন্মস্থান নেত্রকোনায় চলে যাই। সেখানে তিন বছর থাকার পর আবার এখানে চলে আসি। দিনমজুরের কাজ করি আর মানুষের বাড়িতে থাকি। দ্বিতীয় সংসারে দুই ছেলে আর একটি মেয়ে আছে। ছেলে দুজনকে মামার বাড়ি পাঠিয়ে দেই। একমাত্র মেয়েকে নিয়ে এর ওর বাড়িতে থেকে জীবনযাপন করতে থাকি। ৫ বছর আগে আবারও বিয়ে করে সংসার পেতেছিলেন আব্দুল হাকিম, কিন্তু সে স্ত্রী বেশিদিন থাকেনি। চাল চুলোহীন আব্দুল হাকিমকে ছেড়ে চলে গেছেন। এরপর থেকে মেয়েকে নিয়েই আব্দুল হাকিমের গৃহহীন ছিন্নমূল সংসার।
আব্দুল হাকিম আরো জানান, আশ্রয়নের একটা ঘর পাওয়ার জন্য মেম্বার চেয়ারম্যানদের কাছে অনেকবার গিয়েছি। কেউ কোনো সহযোগিতা করেনি। তবে কয়েকমাস আগে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যানের মাধ্যমে ঘর পাওয়ার একটা আবেদন ইউএনও স্যারের নিকট দিয়েছি। ভাইস চেয়ারম্যান আশ^াস দিয়েছেন সামনের বরাদ্দে আমার জন্য ঘরের ব্যবস্থা করবেন।
স্থানীয় যুবক সামিউল বাশার স¤্রাট বলেন, বৃদ্ধ আব্দুল হাকিম বেশ কিছুদিন যাবৎ বাজারের কাছে এই ব্রিজের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছে। তার প্রথম সংসারের দুই ছেলে এই বাজারের সচ্ছল ব্যবসায়ী। কিন্তু বৃদ্ধ পিতার খোঁজ খবর তাঁরা রাখেন না। সরকারিভাবে গৃহহীনদের জন্য বরাদ্দকৃত একটি ঘর তাকে দেয়া হলে খুব উপকার হতো। জীবনের বাকিটা সময় একটু শান্তিতে কাটাতে পারতেন।
কালাপাকুজ্যা ইউপি চেয়ারম্যান মোস্তফা মিয়া জানান, বৃদ্ধ আবদুল হাকিমের সন্তানরা সবাই সচ্ছল, ইচ্ছা করলে পিতার দুঃসময়ে তারা পাশে দাঁড়াতে পারে। আমার ইউনিয়নে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর বরাদ্দের সময় তিনি আমাদের কাছে আসেনি। সময়মতো আসলে একটি ঘর তাঁকে দেয়া যেত। আগামীতে বরাদ্দ আসলে তার জন্য ঘর দেয়ার ব্যবস্থা করব।
লংগদু উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জানান, প্রায় দুই মাস আগে আব্দুল হাকিম আশ্রয়নের ঘর পেতে একটি আবেদন আমাকে দিয়েছে। আমি আবেদনটি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকট দিয়েছি। আশা করছি সামনের বরাদ্দে আব্দুল হাকিমকে একটি ঘর দেয়া হবে।
উল্লেখ্য সরকারি আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের মাধ্যমে লংগদু উপজেলায় মোট তিন দফায় ১৯৫টি ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যার মধ্যে ১২৫টি ঘরে বসবাস শুরু করেছে সুবিধাভোগীরা। আরো ৭০টি ঘরের নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে।