ইয়াছিন রানা সোহেল
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর সারাদেশের ন্যায় রাঙামাটির মুক্তিকামী মানুষও প্রস্তুতি নিতে থাকে সশস্ত্র যুদ্ধের। কিন্তু ২৫ মার্চেও কালো রাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম-রাজশাহীতে পাকবাহিনীর নৃশংসতা আর বর্বরতার পর পাল্টে যায় পুরো দেশ। কেমন ছিলো সেদিনের রাঙামাটি? মহান মুক্তিযুদ্ধে রাঙামাটির প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলা ছাত্রসংগ্রাম কমিটি আর শহরের প্রবীণ মানুষের স্মৃতি থেকেই সেদিনের চিত্রই তুলে আনার চেষ্টা করেছেন পাহাড়টোয়েন্টিফোর ডট কম’র বার্তা সম্পাদক ইয়াছিন রানা সোহেল।
অবিভক্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম (রাঙামাটি-রামগড় ও বান্দরবান মহকুমা নিয়ে গঠিত) রাঙামাটি পার্বত্য জেলায় গঠিত হয়েছিল সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। এই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন গৌতম দেওয়ান আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সুনীল কান্তি দে। অপরদিকে জেলা আওয়ামীলীগ নেতা সৈয়দুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ। জামাতে ইসলামী ও মুসলিম লীগ ছাড়া অন্যান্য দলের সবাই এই সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ছিলেন। ২৫ মার্চের কালো রাতে যখন পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্বিচারে গণহত্যা চালায় তখনো এখানকার মানুষ পাক বাহিনীর সে বর্বরতা সম্পর্কে কিছুই জানেনি। পরদিন ইপিআরের ওয়ারল্যাসের মাধ্যমে জেলাপ্রশাসকের কাছে খবর আসে পাক বাহিনী বিভিন্ন জায়গায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছে।
এই সংবাদ শোনার পর জনমত গঠনের জন্য জেলা প্রশাসক এইচ টি ইমাম ও মহকুমা প্রশাসক (এসডিও) এম আবদুল আলী জেলার সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্র পরিষদের নেতাদের সাথে বৈঠক করেন এবং পরবর্তী করণীয় কি হবে তাও নির্ধারণ করেন।
২৬মার্চ সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ যখন জেলা শহরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে তখন সাধারণ লোকজনের মধ্যে জানাজানি হয় পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালিদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছে। রাঙামাটি জেলার সর্বত্র মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। উত্তেজিত জনতা জড়ো হয়ে ঘাগড়ায় অবস্থিত রেস্ট হাউসের দিকে রওনা হয়। এসময় কয়েকশত মানুষ রাস্তা কেটে এবং রাস্তায় গাছ ফেলে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে।
অপরদিকে জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ইপিআর ও পুলিশ সদস্যদের ট্রাকে করে নিয়ে পৌঁছে দেওয়া হয় চট্টগ্রামে। ২৬ মার্চ তৎকালিন রাঙামাটি কোতয়ালী থানার দ্বিতীয় কর্মকর্তা নুরুল হকের নেতৃত্বে স্থানীয় কয়েকজন যুবকসহ ইপিআরের ৪০সদস্যের একটি টিমকে কালুরঘাটে পৌঁছে দেওয়া হয়।
পুলিশ বাহিনীর অগ্রগামি একটি দলকে ঘাগড়ার রেস্ট হাউসে পাঠানো হয় যাতে শত্রুবাহিনী আসলেই প্রতিরোধ গড়তে পারে। পাশাপাশি জেলা শহরে খবর পৌঁছে দিতে পারে। এতে করে লোকজন নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে পারবেন।
এদিকে প্রতিনিয়ত জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পুলিশ ও ইপিআরের সদস্যদের রাঙামাটি শহরের পুলিশ ক্যাম্পে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। তৎকালিন সংগ্রাম পরিষদের নেতাকর্মীরা চাঁদা তুলে রিজার্ভ বাজারের রহমত আলী হোটেল থেকে রান্না করে ইপিআর ও পুলিশ সদস্যদের খাওয়াতেন এবং পরবর্তীতে তাদেরকে ট্রাকে করে চট্টগ্রাম পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করতেন।
এছাড়াও তৎকালিন কোর্ট বিল্ডিং মাঠের পাশে ট্রাক ও বাস নিয়ে জড়ো করা হয় যাতে পাকিস্তানি বাহিনীর কোনো হেলিকপ্টার এখানে অবতরণ করতে না পারে। যতদুর সম্ভব পানিপথেও নিরাপত্তাবাহিনী জোরদার করা হয়েছিল।
তৎকালিন জেলা আওয়ামীলীগের সদস্য নজির আহম্মদ জানান, ২৫মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাকান্ডের খবর শুনে লোকজনের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আওয়ামীলীগ নেতা সৈয়দুর রহমানের কাছ থেকে জানতে পারি ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন। সৈয়দুর রহমানকে আহ্বায়ক করে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এই কমিটিতে জামাতে ইসলামী ও মুসলিম লীগ ছাড়া অন্যান্য দলের সকলেই সদস্য হিসেবে ছিলেন। জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে আগত পুলিশ ও ইপিআর সদস্যদের আমরা খাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা করতাম। পরে তাদেরকে ট্রাকে করে চট্টগ্রাম পাঠিয়ে দিতাম।
তৎকালিন সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সুনীল কান্তি দে জানান, বর্তমান সময়ের মত তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা এতটা সহজ ছিল না। এতে যেকোনো খবর পেতে একটু সময় লাগতো। রাঙামাটিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন হওয়ার পর চট্টগ্রাম ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা এস এম ইউসুফের সাথে যোগাযোগ রাখতাম এবং তার নির্দেশমত কর্মসূচি পালন করতাম। ২৫ মার্চের হত্যাকান্ডের খবর শুনে পরদিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ রাঙামাটিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে। পর্যায়ক্রমে যুদ্ধের প্রস্তুতিও নিতে থাকে।
সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি গৌতম দেওয়ান জানান, বঙ্গবন্ধুর ৭মার্চের ভাষণের পর থেকেই মুলত আমরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকি। ২৫ মার্চের রাতে হামলার খবর শুনে পরদিন জেলাপ্রশাসকের অনুমতি নিয়ে ঘাগড়া রেস্ট হাউসের সামনে কয়েকশত লোকজনকে নিয়ে রাস্তা কেটে ও রাস্তায় বড় বড় গাছ ফেলে ব্যারিকেড সৃষ্টি করি।
স্বাধীনতা পরবর্তী রাঙামাটি জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শেখ লুৎফর রহমান জানান, মূলত ২৬ মার্চ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত রাঙামাটি শত্রুমুক্ত ছিল। ২৫ মার্চের হামলার পর জেলাপ্রশাসক ও মহকুমা প্রশাসক সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের সাথে জনমত গঠনের জন্য বৈঠক করেন এবং এই বৈঠক থেকে পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হয়। আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে গঠিত সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ও সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য পরিষদের নেতৃত্বে যুদ্ধ প্রস্তুতি চলতে থাকে।
এই ব্যাপারে জানতে রাঙামাটি জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার রবার্ট রোনাল্ড পিন্টুর সাথে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। ডেপুটি কমান্ডার ইকবাল হোসেন চৌধুরী জানান, যুদ্ধকালিন সময়ে তিনি রাঙামাটি জেলার বাইরে যুদ্ধ করেছেন। সে হিসেবে রাঙামাটির অবস্থা সম্পর্কে তিনিও জানেন না।
২৫মার্চ রাত থেকেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি বাহিনী নারকীয় হত্যাকান্ড চালালেও দুর্গম পার্বত্য চট্টগ্রাম তখনো শত্রুমুক্ত ছিল। তারপরেও এখানকার সাধারণ মানুষ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে।