
সারাদেশের তুলনায় তিন পার্বত্য জেলার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সব সময় ভিন্ন। সাধারণ মানুষ থেকে রাজনীতিক, সবারই বিশ্লেষণে এখানকার রাজনীতি মানেই পাহাড়ি-বাঙালি।বাঙালিদের অধিকাংশ জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে পাহাড়িদের রয়েছে একাধিক শক্তিশালী আঞ্চলিক সংগঠন। বাঙালিদেরও রয়েছে আঞ্চলিক সংগঠন। সেগুলো যতটা কাগজে-কলমে, ততটা তৃণমূলে নয়।
বাঙালিদের সংগঠনগুলো জাতীয় পর্যায়ের সিদ্ধান্তকে নিজেদের পক্ষে আনার জন্য কাজ করেন। কিন্তু, পাহাড়ি আঞ্চলিক সংগঠনগুলো জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালিত করে।
তিন পার্বত্য জেলার আঞ্চলিক সংগঠনের মধ্যে শক্ত ও সাংগঠনিকভাবে দক্ষ হিসেবে উঠে আসে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) নাম। এটি ছেড়ে আরো তিনটি সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছে। এর মধ্যে গত নভেম্বরই আত্মপ্রকাশ করেছে একটি। আর সবগুলোই সমান তালে পাহাড়ের বিভিন্ন এলাকায় সক্রিয় ও শক্ত অবস্থান জানান দিচ্ছে।
ইতোমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিরোধিতা করেছে কর্মসূচি পালন করছে সে সময় গঠিত প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ও সুধাসিন্দু খীসার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির অপর (এমএনলারমা) অংশ অন্যতম। বিগত দু’মাস ধরে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মার নেতৃত্বাধীন সদ্য গঠিত ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)।
আর জাতীয়ভাবে রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দীপংকর তালুকদার নিজেই। জেলা বিএনপির দায়িত্বে আছেন সভাপতি শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক দীপন তালুকদার (দীপু)। আর বাকি দলগুলোর নেতারা অনেকটাই চুপচাপ।
এখানে আওয়ামী লীগ-বিএনপির চেয়ে বেশি দা-কুমড়ো সম্পর্ক জেএসএস বনাম আওয়ামী লীগের মধ্যে। এরই সূত্রধরে রাঙামাটিতে আওয়ামী লীগের একের পর এক পাহাড়ি নেতাকর্মীদের হত্যা, হত্যার চেষ্টা ও অব্যাহত হুমকির ঘটনা ঘটছে। নেতাকর্মীরাও রয়েছেন আতঙ্কে। শুধু তাই নয়। জীবন বাঁচাতে শুরু হয়েছে পদত্যাগের হিড়িক।
রাঙামাটি জেলা শহরসহ বিভিন্ন উপজেলায় আওয়ামী লীগের কয়েকশ’ পাহাড়ি নেতাকর্মী লিখিতভাবে পদত্যাগ করেছেন।
গত ৫ ডিসেম্বর রাঙামাটি জেলার জুরাছড়িতে স্থানীয় যুবলীগ নেতা অরবিন্দু চাকমাকে গুলি করে হত্যা ও একই দিন রাতে বিলাইছড়িতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি রামচরণ চাকমা ওরফে রাসেল চাকমাকে হত্যাচেষ্টার প্রতিবাদে পরদিন বিকেলে (৬ ডিসেম্বর) জেলা আওয়ামী যুবলীগের আয়োজনে এক প্রতিবাদ সমাবেশ হয়। অন্যদের সঙ্গে এই সমাবেশে বক্তব্য রাখেন জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ঝর্ণা খীসাও। ঠিক ৬ ডিসেম্বর রাতেই নিজ বাসায় মারাক্রকভাবে কুপিয়ে জখম করা হয় তাকে।
পুলিশ জানায়, সাম্প্রতিক এসব ঘটনায় মোট চারটি মামলা দায়ের হয়েছে। আর পুলিশ বিলাইছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা জনসংহতি সমিতির সভাপতি শুভমঙ্গল চাকমাসহ বিভিন্ন উপজেলায় অভিযান চালিয়ে ১৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এদের মধ্যে জুরাছড়িতে গ্রেপ্তার ৫ আসামি নিজেদের ‘জেএসএস’র কর্মী বলে দাবি করেছেন।
এসব ঘটনার জন্য জেএসএসকে দায়ী করছেন সরকার দলীয় শীর্ষনেতারা। তবে বরাবরের মতই তা নাকচ করছেন জনসংহতি সমিতির নেতারা।
আওয়ামী লীগ থেকেই কেন নেতাকর্মীরা বারবার পদত্যাগ করছেন- এমন প্রশ্নে স্থানীয় আওয়ামী লীগের পদত্যাগকারী নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে ব্যক্তিগত সমস্যা কথা জানালেও আঞ্চলিক দল জেএসএসের হুমকি-ধমকি এবং প্রাণভয়ে তারা পদত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছেন বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বীকার করেছেন।
এ বিষয়ে জুরাছড়ি উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রিকো চাকমা বলেন, ‘একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে আমাদের নেতাকর্মীদের বিভিন্ন মাধ্যমে হুমকি-ধামকি দেওয়া হয়েছে। তাই অসহায় হয়ে তারা অনেকেই দল ছাড়ছেন।’
জুরাছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রবর্তক চাকমা বলেন, ‘তৃণমূল আওয়ামী লীগের শক্তিশালী ভিত ভেঙে দিতে একটি সন্ত্রাসী চক্র হুমকি-ধামকিসহ নানা তৎপরতা চালাচ্ছে। এতে আতঙ্কে অনেকেই দল ছাড়ছেন। তবে এ সংখ্যা খুব বেশি না।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পদত্যাগীরা ভাবছেন আওয়ামী লীগ পাহাড়ি নেতাদের নেতৃত্ব দেওয়ায় শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এজন্য বিএনপির ওপর তেমন খড়্গ পড়ছে না। তবে তাদের বোঝা উচিত, চুক্তি বাস্তবায়ন করলে একমাত্র আওয়ামী লীগই করবে।’
রাঙামাটি সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হৃদয় বিকাশ চাকমা বলেন, ‘আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের পদত্যাগের বিষয়টি সত্য। যেভাবে অসহায় মানুষকে হুমকি-ধামকি দেওয়া হচ্ছে, এতে প্রাণভয়ে পদত্যাগ ছাড়া কোনো উপায় নেই।’
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুছা মাতব্বর বলেন, ‘শুনছি অমুক পদত্যাগ করেছেন, তমুক করেছেন। কিন্তু, আমি কারো পদত্যাগপত্রই পাইনি। পেলেও তা গ্রহণ করা হবে না।’
সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ফিরোজা বেগম চিনু বলেন, ‘মেঘের আড়ালে যে সূর্য আছে, তা মেঘ থাকলেই বোঝা যায়। এখন জেএসএসের অবস্থাও তেমন।’ তিনি বলেন, ‘অগণতান্ত্রিক চর্চা পার্বত্য অঞ্চলের জন্য অশুভ বয়ে আনবে।’
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সজীব চাকমা বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নেতারা সব সময় জনসংহতি সমিতির নেতাদের দোষারোপ করেন। কিন্তু, জনসংহতি সমিতির নেতারা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত নন।’ তিনি বলেন, ‘পদত্যাগকারীরা তো বলছেন তারা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণে দল ছাড়ছেন। তাহলে এ নিয়ে এত দোষারোপের কি আছে?
এই গুলো কি হুমকি নই
কেন?????