পুরো বিশ্ব জুড়ে এখন একটি আতংকের নাম ‘করোনা ভাইরাস’। চীনের উহান শহর থেকে এই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্ব জুড়ে। চীনে বহু হতাহতের পর স্পেন ও ইতালিতে এ ভাইরাসে বেশি সংখ্যক মানুষ মারা গিয়েছে। বর্তমানে সারা বিশ্বের প্রায় ২৭ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছে এই ভাইরাসটিতে। ভাইরাসটি গত কিছুদিন আগে বাংলাদেশেও আক্রমণ শুরু করেছে। ইতিমধ্যে এতে বাংলাদেশে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে রোগতত্ত্ব,রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। এছাড়া বর্তমানে আরো অন্তত ৪৮ জন এ রোগে আক্রান্ত রয়েছে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
দেশে এ মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে যাওয়া ফলে সরকার সারা দেশের গণ পরিবহন, সকল অফিস-আদালত এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছেন, ব্যাংক খোলা রাখতে বলেছেন সীমিত সময়ের জন্য । শুধুমাত্র খোলা রাখতে বলেছেন মুদির দোকান, কাঁচা বাজারের দোকান ও ফার্মেসী। মানুষকে ঘর থেকে বের না হওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বারবার করে বলা হচ্ছে, ইতিমধ্যে মাঠে নেমেছে সশস্ত্র বাহিনী। সশস্ত্র বাহিনী দ্বারা মানুষকে সামাজিক দুরত্ব ও ঘরে রাখতে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে জোরতর ভাবে।
একদিকে তো অফিস-আদালত বন্ধ, তার উপর ঘরবন্দি মানুষ। পারছে না বাহিরে কোথাও ঘুরে বেড়াতে। তাইতো হাতে তেমন কোন কাজও নেই। সময় কাটছে সোস্যাল মিডিয়া, টিভি দেখা, বই পড়া আর পরিবারের সাথে সময় কাটানো মধ্যদিয়ে। আবার অন্যদিকে মনে এক প্রকার বিশাল ভয় নিয়ে ঘুরেবেড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত।
মানুষ যাই বলুক না কেনা, মৃত্যুকে ভয় পায়, এটাই সত্য। তাই তো যে যাই বলুক মনে করছে এটা করলে হয়তো করোনা থেকে মুক্তি পাবো! ঐটা করলে হয়তো করোনা থেকে মুক্তি পাবো! মুক্তির পিঁছে ফুটতে গিয়ে মানুষ এখন ডুবে গেছে গুজবের অতয় সাগরে।
স্যোশাল মিডিয়ার কল্যাণে এ গুজব সহজেই ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। তাই তো রাত দুইটায় মানুষ যাচ্ছে থানকুনি পাতা উদ্ধারে, যদি এ পাতা খেয়ে রোগ সাড়ে!
মনে পড়ে ছোট্ট বেলার কথা, বিকেলে পাড়ার সব বন্ধুরা খেলার শেষে ধান খেতের পাড় দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে হাতমুঠো করে কুঁড়িয়ে আনতাম এই থানকুনি পাতা। এতে যদি করোনা রোগই সাড়তো তবে তো করোনা করুনা করে হলেও আমার দাঁড়েপাশে আসবে না কোনদিন। জীবনে যত থানকুনি পাতা খাওয়া হয়েছে।
আবার শুনা গেলো রং চায়ের গুজব। ছোট্ট শিশু জন্মের পরে নাকি রং চা খেলে করোনা রোগ হবে না এমন মন্তব্য করে পাঁচ মিনিটের মাথায় মারা গেলো। রং চা তো সবাই প্রায় সময় খায় এতে নতুন করে কি ভাবে রোগের ঔষধ সৃষ্টি হলো তা কেবল গুজবকারীরাই জানে।
না জানি কখন আবার তিতকরলা কিংবা করলা নিয়ে গুজব ছড়িয়ে পরে, কারণ এ সবজির নাম গুলোর সাথেও করোনা নামের একটু অন্তত মিল রয়েছে।
তাছাড়া এর আগেও অনেক গুজব ছড়িয়েছে। যেমন: নারিকেলের গাছের পাতা সাদা হয়ে যাওয়া (যদিও এটি একটি পোকার আক্রমণের কারণে হয়েছে বলেই কৃষিবিদরা জানিয়েছেন, তবুও গুজব কি আর চেপে রাখা যায় তা তো ছড়াবেই), পবিত্র ধর্ম গ্রন্থ আল-কোরআন শরীফের মধ্যে চুল পেলে সেটাকে ভিজিয়ে পানি খাওয়া( এমন যদি হতো তবে তো আমার প্রতিটি পাঠ্য বইয়ে হাজারো চুল পাওয়া যাবে, তাহলে এ চুল ভিজিয়ে পানি খেলে কি আমার পড়ালেখায় উন্নতি হবে?) এভাবে বলতে গেলে গুজবের শেষ হবে না।
ওই যে একটা কথা আছে না ‘হুজুগে বাঙালী’, আমাদের অবস্থা ঠিক তেমনি হয়েছে। চিলে কান নিয়ে গেছে এটা শুনেই আমরা দৌঁড়ানো শুরু করি কিন্তু আমাদের কান আদৌ নিয়েছে কিনা তার নিজে হাত দিয়ে দেখি না।
গত বৃহস্পতিবার রাতে তো এমন হলো, হঠাৎ রাত ০১টার দিকে পাড়া থেকে পবিত্র আযানে ধ্বনি শুনতে পেলাম, মনে হলো এতো রাতে আযান এখন আবার কিসের নামাজ, এটা কোন ধরেন নামাজ? এমনই শত শত প্রশ্নের জন্ম হলো আমার মনে। ঠিক তেমনি হয়তো পাঠকের মনেও এমন হাজারো প্রশ্নের জন্ম হয়েছে তখন। পরে ভোর বেলা স্যোশাল মিডিয়ার কল্যাণে জানতে পেলাম মহামারি করোনা ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে ইসলাম ধর্মবলম্বিরা রাতে আযান দিয়েছে, আবার অন্যদিকে সনাতন ধর্মবলম্বিরা উলু এবং শঙ্খ বাজিয়েছে।
আমি এটার বিরোধিতা করতে চাই না। কারণ স্বাভাবিক একটি ভূমিকম্প হলে আমরা দেখতে পাই মুসলিমরা আযান দেয় আবার হিন্দুরা উলু দেয়, হতেই পারে! এ উপমহাদেশের মানুষজন এমনিতে ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট বেশি। তারা যদি মনে করে এতে সৃষ্টিকর্তার কৃপায় মহামারি থেকে রক্ষা পাবে তবে দিক, তাদের মনের শান্তির জন্য হলেও অন্তত দিক।
কিন্তু কিছু বক্তার করোনা ভাইরাস স্বপ্নে আসার মিথ্যা গল্প, ভাইরাসের ঔষধ তৈরির কোর্ড এসব তো শুধুই মিথ্যাচার নয় বরং মানুষের সাথে প্রতারণা করা এবং একই সাথে গুজব ছড়ানো। ঠিক যেনো পার্শবর্তী বন্ধু দেশ ভারতে গো মূত্র খাওয়ার মতই কর্মকান্ড। জেনেছি যে এ গো মূত্র খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলো তিনি নাকি অতিমাত্রায় গো মূত্র পান করায় অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলো। ঠিক তেমনি ভাবে যদি আমাদের এই মিত্যাচার ছড়ানো ব্যক্তিগুলোও মহান স্রষ্টার দ্বারা অভিশপ্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতো। তারপর জানতে চাইতাম এখন কোন স্বপ্নে রোগ এসেছে কিনা এবং আপনাকে আপনার এ রোগের কোন কোর্ড বলে গিয়েছে কি না?
দুঃখ এবং হতাশার বিষয় হলেও সত্য যে, এ গুজবে পিছিয়ে নেই আমাদের বর্তমান তরুন সমাজ। যারা কিনা মানুষকে বুঝাবে কোনটা গুজব এবং কোনটা সঠিক তথ্য, তারাই উল্টা গুজব কানে নিচ্ছে বেশি এবং এরাই গুজব ছড়ানোর দায়িত্ব কাঁদে নিয়ে নিলো। নিবেই না বা কেন, সুন্দর রূপ আর ইংরেজি ভালো বলা বক্তার ভক্ত যে বর্তমান তরুন সমাজেই বেশি।
এটা বড়ই হতাশার, শিক্ষিতরা সুশিক্ষার অভাবে এবং চোখ থাকার পরেও অন্ধ হওয়ার কারণে এমনটাই করছে বলে ধারণা। যার চোখ নেই তাকে পথ দেখিয়ে দেওয়া যায় কিন্তু যার চোখ থাকার পরেও সে পথ দেখতে চাই না তার জন্য কিছুই করার নেই, তবে তার কাছ থেকে সমাজ ও অন্যদের রক্ষার জন্য নিতে হবে সঠিক আইনগত ব্যবস্থা। সরকার এবং প্রশাসনকে এ বিষয়ে বিশেষ নজরদারি বাড়াতে হবে এবং তাদেরকে প্রতিরোধ করতে বিশেষ আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। নয়তো এ গুজব থেকে মানুষ সরে না আসলে ‘করোনা ভাইরাস নয়, গুজবের ভাইরাসে মানুষ আক্রান্ত হয়ে মারা যাবে’।
লেখক: সংবাদকর্মী