করোনা আতংকে যখন সারাবিশ্ব থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সর্বত্রই ব্যবসা বন্ধ করে মানুষ ঘরবন্দী জীবনযাপন করছে,সেই সময়ও পার্বত্য জেলা রাঙামাটির সবচে বড় কৃত্রিম জলাধার কাপ্তাই হ্রদের নিয়ন্ত্রন বাংলাদেশ মৎস উন্নয়ন কর্পোরেশন জেলে ও মাছ ব্যবসায়িদের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এনিয়ে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে রাঙামাটির বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ।

সবচে অবাক করা বিষয়ক, কাপ্তাই হ্রদে মৎস ব্যবসায়িদের যে দুটি সংগঠন আছে, দুটি সংগঠনের পক্ষ থেকেই বিএফডিসি’র ব্যবস্থাপককে মৎস আহরণ বন্ধ করে দেয়ার অনুরোধ জানানো হলেও নাছোরবান্দা প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, মাছ আহরণ ও বাজারজাতকরণ অব্যাহত থাকলেও ‘করোনায় এর কোন প্রভাব পড়বেনা এবং নির্ধারিত সময়ের আগে মাছ আহরণ বন্ধ করা হবেনা বলেও সাফ জানিয়ে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
বিএফডিসি সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিন সকাল ও বিকালে শতাধিক বোটে করে হ্রদের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জেলেরা মাছ নিয়ে আসছে শহরের বিএফডিসি ল্যান্ডিং ঘাটে,সেই মাছ মাপজোখ শেষে ট্রাকে করে যাচ্ছে সারাদেশেপ্রতিদিন রাঙামাটি ল্যান্ডিং ঘাটে বর্তমানে বোট আসছে শতাধিক,এইসব বোটে আসা বিভিন্ন প্রজাতির মাছ পরিমাপ পরিমাণের পর নির্ধারিত শুল্ক শোধ করে ট্রাকে করে চলে যায় মূলত: রাজধানীর উদ্দেশ্যে। এখন গড়ে প্রতিদিন ৪/৫ টি ট্রাক যাচ্ছে। বছরের অন্যান্য সময় প্রতিদিন এই ঘাটে ৪/৫ শ বোট আসে এবং মাছ নিয়ে ট্রাক যায় প্রায় ২৪/৩০ টি। বর্তমানে হ্রদের পানি কমে যাওয়ায় মাছ আহরণও কমে গেছে,ফলে কমে গেছে মাছ পরিবহন। রাঙামাটির বিএফডিসি ল্যান্ডিং ঘাট ছাড়াও কাপ্তাই এবং মহালছড়ি উপজেলায় বিএফডিসির আরো দুটি ঘাট দিয়েও প্রতিদিন মাছ যায় সারাদেশে। বিএফডিসি রাঙামাটি কেন্দ্রের তথ্য মতে, অন্যান্য সময়ে যেখানে প্রতিদিন রাঙামাটি বিএফডিসি’র তিনটি ল্যান্ডিং ঘাট থেকে গড়ে ১৮-২০ টন মাছ আহরণ করা হতো, সেখানে এখন গড় আহরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮-১০ টনে। পুরো রাঙামাটি জেলায় সরকারি তালিকাভুক্ত প্রায় ২২ হাজার জেলে রয়েছে; এ খাতের ওপর নির্ভরশীল জেলার শতাধিক ব্যবসায়ী। আবার একজন ব্যবসায়ীর অধীনে কাজ করেন ৫-৮ শ্রমিক। সেই হিসেবে প্রায় ৫০০ থেকে ৮০০ শ্রমিক ভিড় করেন এখানে।
সরকার যখন করোনা মোকাবেলায় ‘সামাজিক দুরত্ব’ মেনে চলার নির্দেশনা দিয়েছে কঠোরভাবে,সরকারের আইনশৃংখলাবাহিনী যখন সেই নির্দেশনা মানাতে প্রাণান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে,সেই সময় স্বায়ত্বশাসিত একটি প্রতিষ্ঠানের সেই নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোতে ক্ষুদ্ধ পার্বত্য রাঙামাটিবাসি।
রাঙামাটি মৎস ব্যবসায়ি সমিতির সাধারন সম্পাদক উদয়ন বড়ুয়া জানিয়েছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফিসারি খোলা রাখার ঘটনায় মানুষের ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া আমরাও দেখছি। শনিবার বিএফডিসির ব্যবস্থাপক আমাদের ডেকেছিলেন। আমরা তাকে স্পষ্টভাবেই বলেছি, এই কঠিন সময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব। আমরা তাকে পরামর্শ দিয়েছি,যেহেতু ১ মে থেকে স্বাভাবিকভাবেই বন্ধ থাকে,সেই বন্ধটি ১৫ দিন এগিয়ে নিয়ে এসে এই ১৫ এপ্রিল থেকেই বন্ধ করে দেয়ার জন্য এবং খোলার সময় ১৫ দিন আগে খোলার জন্য। কিন্তু তিনি রাজী হচ্ছেন না। বরং আমাদের বলছেন ট্রাক চালকদের পৃথকভাবে থাকার জন্য একটি রুমের ব্যবস্থা করতে। আমরা বিনীতভাবে রাঙামাটির প্রশাসনের কাছে অনুরোধ করছি,রাঙামাটিবাসির স্বার্থেই যেনো এখনই মাছ আহরণ বন্ধ করে দেয়া হয়।’
কাপ্তাই হ্রদ মৎস ব্যবসায়ি সমিতির সভাপতি মো: কবির বলেন-‘এইভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসা করার তো কোন মানেই হয়না। আমরাও চাই বিএফডিসি মৎস আহরণ এখনই বন্ধ করুক। কিন্তু ওনারা নিজেদের লাভের বিষয়টি চিন্তা করে বন্ধ করতে চাইছেন না। অযথা আমরা রাঙামাটিবাসির গালাগালি ও অপবাদ শুনতেছি। আমরা টাকা পয়সা দিয়ে কি করব,জীবনই যদি না বাঁচে। আমরাও চাইনা আমাদের কারণে কারো মৃত্যুর ঝুঁকি তৈরি হোক।’
রাঙামাটির বিশিষ্ট মৎস ব্যবসায়ি মোঃ মাহাফুজ বলেন, এই সময়ে ফিসারি খোলা রাখার কোন মানেই হয়না। জীবনের চেয়ে তো ব্যবসা বড় হতে পারেনা। কিন্তু বন্ধের সিদ্ধান্ত তো আমরা নিতে পারিনা,বিএফডিসিকেই নিতে হবে। বর্তমানে এভাবে চললে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। হ্রদে মাছ নেই,আবার যা মাছ পাচ্ছি,তাও বিক্রি করতে পারছিনা। এতে আমাদেরও ক্ষতি হচ্ছে আবার জেলার মানুষের জীবনও ঝুঁকিতে পড়ায় সবাই আমাদের গালাগাল করছে।’
এই বিষয়ে বিএফডিসি রাঙামাটির ব্যবস্থাপক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘যে ট্রাক চালকরা প্রতিদিন মাছ নিয়ে ঢাকায় যাচ্ছেন তারা রাঙামাটিতে ফিরে আসার পর তাদের শরীরে এবং গাড়ীতে প্রয়োজনীয় স্প্রে করা এবং তাদের পৃথকভাবে থাকার জন্য আমরা উদ্যোগ নিচ্ছি।’ হ্রদের বিভিন্ন স্থান থেকে আস্থা শতাধিক জেলে বোটের লোকদের ও বিএফডিসি চত্বরে সামাজিক দূরত্ব কিভাবে নিশ্চিত করবেন,এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন-‘ সবকিছু পুরোপুরি সম্ভব না,সবখানে কি সবকিছু ঠিকঠাক হচ্ছে ? এটা সম্ভব না।’ মাছ আহরণ বন্ধ করার বিষয়ে তিনি বলেন,‘ বিষয়টি আমাদের হাতে নেই, এটা উপর থেকে আসতে হবে।’ মাছ আহরণ ও বাজারজাতকরণের কারণে ‘ করোনার কোন প্রভাব’ পড়বেনা বলেও দাবি করে, আগামী ১ মে নির্ধারিত সময়ের আছে মাছ আহরণ বন্ধ হওয়ার কোন ভাবনাও আপাতত নেই বলে জানিয়েছেন তিনি। এখন মাছ আহরণ বন্ধ হলে ঢাকায় মাছের চাহিদায় সংকট তৈরি হবে বলেও জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, ১৯৬১ সালে প্রমত্তা কর্ণফুলি নদীতে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে তৎকালিন পাকিস্তান সরকার। এর ফলে নদীর উজানে তৈরি হয় ৭০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বিশাল হ্রদ,যা ‘কাপ্তাই হ্রদ’ নামেই পরিচিত। ১৯৬৪ সাল থেকে এই হ্রদের মৎস আহরণ,বাজারজাতকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ এর দায়িত্ব পালন করে আসছে বাংলাদেশ মৎস উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএফডিসি)। প্রতিবছর মে মাসের ১ তারিখ থেকে ৩ মাসের জন্য বন্ধ রাখা হয় হ্রদে সকল প্রকার মাছ আহরণ। এই সময়ে হ্রদে ছাড়া হয় কার্প জাতীয় মাছের পোনা। মূলত এই মাছের পোনার বংশবৃদ্ধির জন্যই বন্ধ রাখা হয় মাছ আহরন ও বাজারজাতকরণ।