প্রান্ত রনি
রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান- এই তিন পার্বত্য জেলা দেশের প্রত্যন্ত পশ্চাৎপদ অঞ্চল। শিক্ষা, চিকিৎসা ও সচেতনতার দিক দিয়ে সমতল জেলাগুলোর চেয়ে এখনো অনেকাংশে পিছিয়ে রয়েছে তিন পাহাড়ি জেলা। সাম্প্রতিকসময়ের এক জরিপে উঠে এসেছে, করোনাকালীন এক বছরে তিন পার্বত্য জেলার ২৫টি উপজেলায় ১ হাজার ৬৫৩টি বাল্য বিবাহের ঘটনা ঘটেছে। দারিদ্রতায় ঝরে পড়েছে ৫ হাজার ৩৭ জন। পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এই জরিপ চালিয়েছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে সামাজিক ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে একযোগে কাজ করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের মার্চে দেশে মরণঘাতী নভেল করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) প্রাদুর্ভাব দেখা হয়। এরপর ৩১ মার্চ থেকে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে ধাপে ধাপে বাড়ানো হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের মেয়াদ। উদ্ভূত এই পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিমুখ হয়ে পড়েন শিক্ষার্থীরা। কভিডকালীন এই সময়ের মধ্যে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাল্য বিবাহ নিয়ে একটি জরিপের কাজ শুরু করে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড। প্রতিষ্ঠানটির পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে টেকসই সামাজিক সেবা প্রদান প্রকল্পের আওতায় তিন পার্বত্য জেলায় ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর এই দুইমাসে জরিপ কার্যক্রম শুরু হয়। জরিপ কার্যক্রমে এলাকায় গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেন তিন জেলার ৪ হাজার ৫৯২টি পাড়াকেন্দ্রে কর্মরত পাড়াকর্মী ও মাঠ সংগঠকগণ। প্রতিষ্ঠানটির জরিপের প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিগত এক বছরে তিন পার্বত্য জেলায় মোট ১ হাজার ৬৫৩টি বাল্য বিবাহ হয়েছে। তন্মধ্যে খাগড়াছড়ি জেলায় ৬৮৪, বান্দরবানে ৫২৮ ও রাঙামাটিতে ৪৪১ বাল্য বিয়ের ঘটনা ঘটেছে। তবে বান্দরবানে ৫২৮টি বাল্য বিয়ের মধ্যে লামা উপজেলাতেই ২০৩টি। লামা উপজেলায় বিগত এক বছরকালীন সময়ে সবচেয়ে বেশি বাল্য বিবাহ প্রবণ এলাকা।
প্রতিবেদনে উপজেলাভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী, খাগড়াছড়ি সদর উপজেলায় ৪৬, লক্ষ্মীছড়িতে ১৩৯, মানিকছড়িতে ১১০, রামগড়ে ১৩৬, দীঘিনালায় ১১৮, মহালছড়িতে ৫৫, পানছড়িতে ৩৮, গুইমারায় ১৪ ও মাটিরাঙ্গায় ২৮টি। রাঙামাটি সদর উপজেলায় ২, কাপ্তাই উপজেলায় ৪১, কাউখালীতে ৭৯, রাজস্থলীতে ২৯, নানিয়ারচরে ১৪, লংগদুতে ১৩১, বাঘাইছড়িতে ৬৪, বরকলে ৩৭, জুরাছড়িতে ২৩ ও বিলাইছড়িতে ২১টি। বান্দরবান সদর উপজেলায় ৯৫, রোয়াংছড়িতে ৪১, রুমায় ১৩, থানচিতে ৬৫, লামায় ২০৩, আলীকদমে ৫৩ ও নাইক্ষ্যংছড়িতে ১১১টি। উপজেলাভিত্তিক সবচেয়ে বেশি বাল্য বিবাহ যে পাঁচ উপজেলায় সেগুলো হলো- আলীকদম ২০৩, লক্ষ্মীছড়ি ১৩৯, রামগড় ১৩৬, লংগদু ১৩১ ও দীঘিনালা ১১৮টি। সবচেয়ে কম বাল্য বিবাহ প্রবণ উপজেলা হলো- রাঙামাটি সদর ২, রুমা ১৩, গুইমারা ১৪, নানিয়ারচর ১৪ এবং বিলাইছড়ি ২১টি।
জরিপে দারিদ্রতার কারণে কিশোর-কিশোরীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়ার দিকটিও উঠে এসেছে। জরিপে দেখা গেছে, পার্বত্য তিন জেলায় ৬৮ হাজার ৪৭৩ জন কিশোর-কিশোরী রয়েছে; এরমধ্যে ৫৬ হাজার ৪২ জন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়া-আসা করছে। তবে কভিডকালে দারিদ্রতার কারণে ঝরে পড়েছে ৫ হাজার ৩৭ জন কিশোর-কিশোরী। ঝরে পড়া কিশোর-কিশোরীর সংখ্যা খাগড়াছড়িতে ১ হাজার ৫৬১, রাঙামাটিতে ১ হাজার ৩৪৮ ও বান্দরবানে ২ হাজার ১২৮। দারিদ্রতার কারণে উপজেলাভিত্তিক সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে লামায় ৫৬৭, নাইক্ষ্যংছড়িতে ৪০৫, বিলাইছড়িতে ৩৫৫, মানিকছড়িতে ৩৪৫ ও বান্দরবান সদর উপজেলায় ৩১২ জন।
প্রকল্পটির তিন পার্বত্য জেলার প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর শুভাশীষ তালুকদার জানান, জরিপের কাজে আমি মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শন করেছি এবং বাল্য বিবাহের প্রমাণ পেয়েছি। আমি খাগড়াছড়ির লক্ষ¥ীছড়ি উপজেলার দুল্যাছড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ে পরিদর্শনকালে বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জানিয়েছে, তাদের বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণীতে ১২৭ জন শিক্ষার্থী ছিলো। যার মধ্যে ২৩ জন শিক্ষার্থী দারিদ্রতা ও বাল্য বিবাহের কারণে ঝরে পড়েছে। জরিপের তথ্যের আলোকে আমরা বাল্য বিবাহ বন্ধে কাজ করেছি।
এদিকে, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় শিশু সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছে উন্নয়ন বোর্ড। কর্মসূচির অংশ হিসাবে উপজেলা পর্যায়ে বাল্য বিবাহ নিরোধ কমিটির সঙ্গে বৈঠক, জন্ম ও বিবাহ নিবন্ধকের জন্য ওরিয়েন্টশন কর্মশালা, ইউনিয়ন পর্যায়ে বাল্য বিবাহ নিরোধ কমিটির সঙ্গে বৈঠক। ক্লাস্টার পর্যায়ে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধবিষয়ক কমিউনিটি সংলাপ, জনবহুলস্থানে বাল্য বিবাহ নিরোধবিষয়ক সচেতনতামূলক বার্তা সম্বলিত বিলবোর্ড স্থাপন, ইউনিয়ন পর্যায়ে গণমাণ্য ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে বাল্য বিবাহ নিরোধবিষয়ক ওরিয়েন্টেশন কর্মশালা।
তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাল্য বিবাহ নির্মূলে স্থানীয় হেডম্যান-কার্বারি (প্রথাগত প্রতিষ্ঠান প্রতিনিধি), ইউনিয়ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের (ইউপি চেয়ারম্যান-সদস্য) মুখ্য ভূমিকা রাখতে হবে বলে মনে করেন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও ক্রীড়া সংগঠক নাছির উদ্দিন সোহেল। তিনি বলেন, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার ও সংরক্ষিত নারী মেম্বারগণকে বাল্য বিবাহ নির্মূলে প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে। এক্ষেত্রে হেডম্যান-কার্বারি ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের পিছিয়ে থাকা যাবে না। এ ব্যাপারে প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে টেকসই সামাজিক সেবা প্রদান প্রকল্পের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ এয়াছিনুল হক জানান, প্রথম ধাপে খাগড়াছড়ি জেলার তিনটি উপজেলায় আমরা জরিপ করি। সেই জরিপ থেকে প্রাপ্ততথ্য দেখে আমরা তিন পার্বত্য জেলার ২৫টি উপজেলাতেই জরিপের উদ্যোগ নিই। জরিপে তিন পার্বত্য জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে কভিডকালীন সময়ে বাল্য বিবাহ ও দারিদ্রতার কারণে ঝরে পড়া কিশোর-কিশোরীদের চিত্র ওঠে এসেছে। তাই বাল্য বিবাহ নিরোধে সামাজিক আন্দোরন গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমরা বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় নারী-শিশু অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন নারীনেত্রী ও অধিকারকর্মী টুকু তালুকদার। পার্বত্য এলাকায় বাল্য বিলাহ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শিক্ষা ও পারিবারিকক্ষেত্রে ছেলে সন্তানের চেয়ে কন্যা সন্তানরা আগে থেকেই বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছে। সমাজ ও পরিবারে মেয়ে সন্তানের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন এখনো হয়নি। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি না হওয়ায় এখনো বাল্য বিবাহ ও দারিদ্রতার কারণে সর্বপ্রথম কন্যা সন্তানরাই ঝরে পড়ছে। যে কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম এলাকাগুলোতে অনেক কিশোরী বাল্য বিবাহের শিকার হচ্ছেন; যার কারণে বিবাহিত জীবনে পারিবারিক কলহ, সন্তান প্রসবে জটিলতা ও অন্যান্য দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। টুকু তালুকদার মনে করেন, সাধারণত শিশু অধিকার নিশ্চিতে ইউজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে বাল্য বিবাহ নিরোধে যে কমিটিগুলো রয়েছে যেগুলো শুধুমাত্র কাগজে-কলমে নামসর্বস্ব। এজন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সামাজিকভাবে কন্যা সন্তানের প্রতি পরিবারের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও শিশু অধিকার রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা প্রয়োজন।