সুহৃদ সুপান্থ
রাঙামাটি পৌরসভা নির্বাচনে বরাবরই ‘ফ্যাক্টর’ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। পার্বত্য এই শহরে ‘নগরপিতা’ নির্বাচনে জয়ী হওয়া কিংবা পরাজিত হওয়া,দু’ক্ষেত্রেই কমবেশি ভূমিকা থাকে দলটির,দলের নেতাকর্মীদের,সমর্থক ও শুভাকাংখীদের। দলটির গত এত দশকের নির্বাচনের ফলাফলও ঈর্ষনীয়। ২০১১ সালের ১৮ জানুয়ারি,২০১৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর,সর্বশেষ দুই পৌরসভা নির্বাচনে যথাক্রমে ১০,৮৮৩ এবং ৭,৩৫৫ভোট পেয়েছিলো দলটি। একবার জয়ী আর অন্যবার ভোট শুরুর তিনঘন্টা পরই নির্বাচন বর্জন করেও বিপুল ভোট। অথচ ঠিক পাঁচ বছর পরেই ‘দৃশ্যত শান্তিপূর্ণ ভোট’ আর বিপুল ভোটারের উপস্থিতির নির্বাচনে ‘পুরোদিন নির্বাচন’ করে গত দুইবারের গন্ডিই পেরোতে পারেনি দলটি, এবারের ভোট ৬৯৩৫ ! অথচ সারাদিনমানের ভোটারের তৎপরতা জানান দিচ্ছিলো ‘বাঁকে ফেরার’ ! কিন্তু দিনশেষের চিত্র যে বড়ই বেদনার ! মাত্র ভোট পাওয়া বিএনপি বিস্ময়ে বিমূঢ়,হতবাক ! ভোটের সংখ্যা দেখে আঁৎকে উঠেনি এমন বিএনপি কর্মীও হাতে গোণা ! কিন্ত কেনো ? সারাদিন ধরে কেন্দ্রে কেন্দ্রে দীর্ঘ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকা বিএনপির ভোটগুলো তবে কোথায় গেলো ? এই বিষয়টি আমরা জানান চেষ্টা করেছি বিএনপির প্রার্থী অ্যাডভোকেট মামুনুর রশীদ এবং জেলা বিএনপির সভাপতি মোঃ শাহ আলমের কাছ থেকে। এই দুই নেতা ভোটের দিনে নিজেদের চোখে দেখা নানা কর্ম,অভিজ্ঞতা আর নানা বিশ্লেষন জানিয়েছেন পাহাড়টোয়েন্টিফোর ডট কমকে।
অ্যাডভোকেট মামুনুর রশীদ,মেয়র প্রার্থী,বিএনপি
বিএনপির ধানের শীষের প্রতীকে মেয়র পদে নির্বাচন করা সদর থানা বিএনপির সভাপতি ও জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক অ্যাডভোটে মামুনুর রশীদ শহরবাসির খুব চেনা মুখ। রেডক্রিসেন্ট,জেলা ক্রীড়া সংসস্থা,রোটার্যাক্ট ক্লাব,রোটারি ইন্টারন্যাশনাল,সাউথ রাঙামাটিসহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক ক্রীড়া সংগঠনের সাথে জড়িত থাকা মামুন পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির নেতা হিসেবেই পরিচিত। ধারণা করা হয়েছিলো মেয়র পদে তিনি বেশ শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলবেন। কিন্তু বাস্তবতা দেখলো কঠিন উদাহরণ। ভোটের দিনের অভিজ্ঞতা জানালেন মামুন বেদনাহত কন্ঠেই-‘একটা পৌর নির্বাচন প্রমাণ করে দিয়েছে একটা দেশের প্রশাসন কতটা নির্লজ্জ আর দলকানা হতে পারে। পুরো প্রশাসন যেভাবে সরকারি দলের পক্ষে ভূমিকা রেখেছে তা দেখে আমার লজ্জাই লেগেছে। প্রিজাইডিং অফিসার ও সহকারি প্রিজাইডিং অফিসাররা দলীয় কর্মীর মতো ভূমিকা পালন করেছে।’
মামুন বলেন,বাইরে সবকিছু দৃশ্যত ঠিকঠাক রেখে,ভোট ডাকাতির যে আধুনিক পদ্ধতি তারা ব্যবহার করেছে,তা ইতিহাসে বিরল। ভোট কি ভোটাররা দিয়েছে নাকি এজেন্টরা দিয়েছে,সেটা আপনারা ভোটারদের কাছে জিজ্ঞেস করলেই জানবেন। সাধারন ভোটারদের ভোট বুথের ভেতর ঢুকেই নৌকার এজেন্টরা ভোট দেয়ার পদ্ধতি শেখানোর নামে মেরে দিয়েছেন। এভাবে প্রকাশ্যেই এজেন্টরা সারাদিন এইকাজ করলেও প্রিজাইডিং অফিসার ও সহকারি প্রিজাইডিংরা বাধা না দিয়ে সহযোগি হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। সাধারন ভোটাররা বুঝতেই পারেনি তাদের সাথে কি ভয়ানক প্রতারণা করা হয়েছে। এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা আল্লাহও সহ্য করবে না।’
অ্যাডভোকেট মামুন বলেন-‘ তারা আলফেসানি স্কুল,ওয়াপদা রেস্ট হাউজ,গোধূলী আমানতবাগ,ভেদভেদী প্রাথমিক কেন্দ্র থেকে সকালেই ধানের শীষের এজেন্টদের বের করে দিয়েছে। আমি প্রশাসন ও নির্বাচনী কাজে নিয়োজিতদের কাছে বারবার ফোন করেও সাড়া পাইনি।’ গার্লস হাই স্কুল কেন্দ্রে প্রিজাইডিং অফিসার তো দলীয় কর্মীর চেয়েও খারাপ ভূমিকায় ছিলেন,তার সামনেই নৌকার এজেন্টরা ভোটারদের সাথে বুথে ঢুকে ভোট দিচ্ছে, সে কিছুই বলেনি ! রাণী দয়াময়ী স্কুল কেন্দ্রে তো এক পর্যায়ে সরকারি দলের নেতাকর্মীরাই সবকিছু নিয়ন্ত্রন করেছে।’
মামুন প্রশ্ন রাখেন, বদিউজ্জামান সোহাগ কে ? সে কি করে ভোটের দিন কেন্দ্রে কেন্দ্রে ঘুরে বেড়ায় বহর নিয়ে ? আইন কি তাকে এই অধিকার দিয়েছে নাকি সে আইনের উর্ধে ?’ভোটের দিন ভোটের এলাকায় বহিরাগত প্রবেশ করতে পারেনা, এটা নির্বাচন কমিশনের আইন। এটা কে মেনেছে ?’
ধানের শীষের এই প্রার্থী আরো অভিযোগ করেছেন, ‘ বুথ তৈরি নামে পাতলা একটি কাপড় দিয়ে পৃথক ভোট দেয়ার জায়গা তৈরি করা হয়েছে,সেটি এতই পাতলা যে, কে কোন মার্কায় ভোট দিচ্ছে সবই দেখা গেছে। আর এর পাশেই নৌকার এজেন্টরা ! হয় ভোট দেয়া দেখছে নতুবা ভোট দিতে সহযোগিতার নামে বুথে ঢুকে সুইচ টিপেছে। ’
রিজার্ভবাজার এলাকায় শাওয়াল (জেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের সভাপতি)’ই ছিলো সব। সে যা ইচ্ছা তাই করেছে। ইচ্ছেমতো ঢুকেছে,বের হয়েছে। যা ইচ্ছা তাই করেছে। আমাদের নেতাকর্মীদের হুমকী-ভয়ভীতি দেখিয়ে সরিয়ে দিয়েছে।’
‘এত অভিযোগ ভোটের দিন কেনো জানাননি’- এমন প্রশ্নের জবাবে মামুন বলেন-‘ কার কাছে অভিযোগ করব ? কার কাছে বিচার চাইব ? যে প্রশাসন নির্লজ্জভাবে একটি দলের এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে,তাকে অভিযোগ করে লাভ কি হতো ?’ সাংবাদিকদের বলেও লাভ কি বলেন ? তারা সারাদিন পিকনিকমুডে গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে,একটি কেন্দ্রের কোথাও কি তারা এজেন্টদের ভোট দেয়ার উৎসবের ছবি বা খবর প্রচার করেছে ? তারা কি একটি অনিয়মের সংবাদও দেখিয়েছে বা লিখেছে কোথাও? দলীয় সাংবাদিকদের বাইরে যারা আছেন,তারা তো লিখতে পারতেন,বলতে পারতেন ! নাকি ‘সুকৌশলের ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’ সাংবাদিকদের চোখকেও ফাঁকি দিয়েছে ?’
পুরো বিষয়টিকেই নিজের রাজনৈতিক জীবনের ‘অবাক এক অভিজ্ঞতা’ মেনে নিয়ে মামুন বলেন, এতদিন সারাদেশের ভোটের অনিয়ম আর ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং এর খবর পড়েছি ও দেখেছি। এবার নিজেই এর শিকার হলাম। এই নির্বাচন থেকে এই শিক্ষাটাই হলো যে, এই সরকারের অধীনে কোন নির্বাচনই সুষ্ঠু ও অবাধ হতে পারে না। এবং এদের অধীনে আর কোন নির্বাচনে যাওয়াও হবে আমাদের জন্য বিরাট বোকামি। আমি আমার দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের অনুরোধ করব, তারা যেনো এই সরকারের ‘নির্বাচনী ফাঁদ’-এ আর পা না দেয়।
মামুন বলেন- আমি হারিনি, আমাকে হারানো হয়েছে। আমার ভোট কেড়ে নেয়া হয়েছে। আমি রাঙামাটিবাসির প্রতি কৃতজ্ঞ,তারা আমাকে ভোট দিয়েছেন,ভোট দিতে কেন্দ্রে এসেছেন। আজীবন এই ভালোবাসা শ্রদ্ধার সাথে মনে রাখব। আমি চেষ্টা করব আজীবন তাদের পাশে থাকার।’
হাজী মো: শাহ আলম,সভাপতি,রাঙামাটি জেলা বিএনপি
ভোটের ফলাফলে ‘বিস্ময়’ প্রকাশ করে রাঙামাটি জেলা বিএনপির সভাপতি হাজী মোঃ শাহ আলম বলেছেন-সারাদিন আমাদের নেতাকর্মীরা যে ভোট দিলো,সেগুলো কোথায় গেলো ? এটা ব্যবধান অসম্ভব ! আওয়ামীলীগের প্রার্থী জিততেই পারেন,তাই বলে আমাদের যে ভোট দেখানো হলো,সে কিভাবে মেয়ে নেয়া সম্ভব ? ইভিএম- একটি ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং সফটওয়ার এটা আবারো প্রমাণিত হলো রাঙামাটিতে।’
শাহ আলম আরো বলেন, অবাক করা ব্যাপার কোন কোন কেন্দ্রে আমাদের দলের কাউন্সিলর প্রার্থী যে ভোট পেয়েছে তার চারভাগের একভাগ ভোটও পায়নি ধানের শীষ !
তিনি বলেন- নৌকার এজেন্টরা ভোট দেখানোর নামে সাধারন মানুষের ভোট মেরে দিয়েছে,সেটার কারণে ভোট বাড়তে পারে ২/৩ হাজার। কিন্তু ভোটের যে ব্যবধান দেখানো হলো,সেটা অবাস্তব। রাঙামাটির মানুষ এটা বিশ^াস করেনা।’
শাহ আলম অভিযোগ করেছেন,গার্লস হাই স্কুলে কেন্দ্রে প্রিজাইডিং অফিসারের ভূমিকা নিজের চোখে যা দেখেছি তা দু:খজনক। প্রায় সবকেন্দ্রেই কমবেশি একই রকম অবস্থা ছিলো।’
‘ভোটের বাইরের পরিবেশ ঠিকঠাক দেখিয়ে,ভেতরে বসে ভোট ডাকাতির মহা আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছে’ জানিয়ে তিনি বলেন, আগের দিন একটি বিশেষ স্থানে বিশেষ সভার বিষয়টিও রাঙামাটির মানুষ জেনে গেছে। এভাবে নির্বাচন হয় না,প্রহসন হয়।’
সারাদেশের মতো রাঙামাটিতেও একটি ‘ভোট নাটক’ হয়েছে মন্তব্য করে মোঃ শাহ আলম বলেন- এই সরকারের কাছে এই দেশের মানুষের ভোটের অধিকারও যে নিরাপদ নয়,সেটাই আরেকবার প্রমাণিত হলো।’