দ্বিতীয় ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে পার্বত্য জেলা রাঙামাটির দশ উপজেলার তিনটিতেই ভোট বর্জন করেছে পাঁচজন চেয়ারম্যান প্রার্থী। ‘রাতে ভোট গ্রহণ, দিনে বেলায় ভোটারদের কেন্দ্রমূখী হতে না দেয়া ও ভাড়াতে ভোটারের’ অভিযোগ এনে তারা ভোট বর্জন করেছেন। ভোট বর্জন করে পুনর্নিবাচনের দাবি জানিয়েছেনও তারা। তবে ভোট নিয়ে কোথাও কোনও সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায়নি। এর আগে দশ উপজেলার মধ্যে দুই উপজেলায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকায় আওয়ামীলীগের দুই প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
ভোটের দিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রাঙামাটি শহরের কেন্দ্রগুলো ভোটারের উপস্থিতি তেমন লক্ষ্য করা যায়নি। বিশেষ করে বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায়। তবে পাহাড়ি অধ্যুষিত এলাকায় ভোটারের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। এ ব্যাপারে সদরের চেয়ারম্যান প্রার্থী অরুণ কান্তি চাকমা বলেছেন, ‘পূর্বের নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিয়ে সাধারণ মানুষ ভোট বিমুখ হয়েছে। এছাড়া ভোটার না আসায় বিভিন্ন কেন্দ্রে জালভোট এবং বাইরে থেকে ভোটার এনে ভোট দেয়া হচ্ছে।’
রাঙামাটি শহরের কলেজ গেইট গোধূলি আমানতবাগ কেন্দ্রের ভোটার সাইফুল উদ্দীন। সকাল সাড়ে নয়টায় ভোট কেন্দ্রে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখেন, তার ভোটটি কেউ একজন দিয়ে দিয়েছেন। এই বিষয়টি তিনি প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে জানিয়েছেন বলে জানান। ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা গোলাম হোসেন বলেন, ‘বেশ কিছু ছেলে জালভোট দিতে কেন্দ্রে জড়ো হয়েছিল। পরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের বের করে দেয়। তারপরও কয়েকটি জালভোট পড়তে পারে। এটা অস্বাভাবিক কিছু না।’
ওই সময় একই কেন্দ্র থেকে কয়েকজন যুবক ভোট দিয়ে বের হতে থাকে। নাম পরিচয় জানতে চাইলে সে জানায় তার বাড়ি জেলার লংগদু উপজেলায়। লংগদু উপজেলার বাসিন্দা হয়ে সদরে কেন ভোট দিচ্ছেন এমন প্রশ্ন করলে সে দ্রুত ছুটে চলে যায়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিভিন্ন এলাকা থেকে ভাড়াতে ভোটার এনেছে বলে অভিযোগ করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বর্তমান চেয়ারম্যান অরুণ কান্তি চাকমা।
অন্যদিকে বাঘাইছড়ি, নানিয়ারচর ও কাউখালী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে পাঁচ চেয়ারম্যান প্রার্থী ভোট বর্জন করেছে। একই সাথে সাত ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীও তাদের ভোট বর্জনের খবর জানিয়েছেন। বাঘাইছড়ি ও নানিয়ারচর এই দুই উপজেলাতেই জাতীয় রাজনৈতিক দলের কোনও দলই অংশ নেয়নি। তবে কাউখালীতে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী আছে।
‘রাতে ভোট গ্রহণ ও দিনে বেলায় ভোটারদের কেন্দ্রমূখী হতে না দেয়া’র অভিযোগ এনে বাঘাইছড়ি উপজেলায় সকাল দশটায় ভোটবর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী বড়ঋষি চাকমা এবং তিন ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী। এ উপজেলায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির দুটি অংশের প্রভাবশালী দুই নেতা বড়ঋষি চাকমা ও সাবেক চেয়ারম্যান সুদর্শন চাকমা মুখোমুখি হয়েছিলেন এবার চেয়ারম্যান পদে।
ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়ে বড়ঋষি চাকমা অভিযোগ বলেন, ‘গতকাল রাতেই বিভিন্ন কেন্দ্রে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ভোটগ্রহণ করা হয়েছে। ভোটের দিন সকাল থেকেই আমার সমর্থক ভোটারদের কেন্দ্রে আসতে বাধা দেয়া হয়।’ তিনি বলেন, জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) বিপুল সংখ্যক বহিরাগত ও সশস্ত্র কর্মী এলাকায় অবস্থান নিয়ে ভোট সন্ত্রাস করলেও প্রশাসন কোনও পদক্ষেপ না নেয়ায় আমি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলাম। আমার সাথে আরও তিন ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীও নির্বাচন বর্জন করেছে।
নানিয়ারচরের চেয়ারম্যান প্রার্থী স্বতন্ত্র রূপম দেওয়ান অভিযোগ করেছেন, রাতেই বেশিরভাগ কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শেষ হয়ে গেছে এবং দিনের বেলায় আমরা ও আমাদের ভোটাররা কেন্দ্রেই যেতে পারছি না। সঙ্গত কারণেই নির্বাচনে থাকার কোন মানে নেই। তাই আমিসহ তিন চেয়ারম্যান প্রার্থী এবং চার ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী বর্জন করে নির্বাচন থেকে সরে গেলাম।
এ উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থী জোন্তিনা চাকমা, পঞ্চানন চাকমাও নির্বাচন বর্জন করেছেন। বর্জনকারি ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীরা হলেন- রণ বিকাশ চাকমা, সুজিত তালুকদার, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান কোয়ালিটি চাকমা ও কনিকা চাকমা।
নানিয়ারচর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো: মাসউদ পারভেজ মজুমদার বলেছেন, ‘তিন চেয়ারম্যান ও চার ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী নির্বাচন স্থগিত করার জন্য আমার কাছে একটি আবেদন জমা দিয়েছেন। বিষয়টি আমি রিটার্নিং অফিসারকে জানিয়েছি।’
অন্যদিকে, জেলার কাউখালী উপজেলায়ও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন জেএসএস ও ইউপিডিএফ সমর্থিত প্রার্থী অর্জুন মনি চাকমা। বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে তিনি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। এই উপজেলায় দুই চেয়ারম্যান প্রার্থী আওয়ামীলীগের শামসুদ্দৌহা ও স্বতন্ত্র প্রার্থী অর্জুন মনি চাকমার মধ্যে অর্জুন মনি চাকমা ভোট বর্জন করেন। তিনি জানান, ‘ব্যাপক ভোট কারচুপি ও ভোট প্রদানে ভোটারদের বাধার কারণে আমি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছি।’
বাকি ছয় উপজেলা বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি, কাপ্তাই, রাজস্থলী, লংগদু ও বরকলে নির্বাচন মোটামুটি সুষ্ঠু হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে ভোটারের উপস্থিতি কম ছিলো বলে জানা গেছে। বেশিরভাগ কেন্দ্রই ছিল ফাঁকা।
রাঙামাটির রিটার্নিং অফিসার ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) এসএম শফি কামাল জানান, নানিয়ারচর, বাঘাইছড়ি ও কাউখালীতে ভোট বর্জনের খবর জেনেছি। ভাড়াটে ভোটারের অভিযোগের ভিত্তিতে তিনি বলেন, ‘আমরা এমন দু’একটা ঘটনা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে গিয়েছি। তবে কোনো সত্যতা পাইনি।’