
পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনীতির বলিতে ‘নিখোঁজ’ এক নেতা আর তার পুরো পরিবারটি এখন অসহায় হয়ে পথে বসার উপক্রম। ‘নিখোঁজ’ নেতার বেঁচে থাকার আশা ছেড়ে দিয়ে তার স্বজনরা অনেকটা গোপনে অন্তেঃষ্টিক্রিয়া সেরে ফেললেও ঘটনা প্রকাশ করতে পারছেনা প্রতিপক্ষের ভয়ে। পরিবার প্রধান ‘নিখোঁজ’ হওয়ার পর দুমুঠো খাবার সংগ্রহে দিনমুজুরিতে নেমেছেন তার স্ত্রী। লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে সদ্য এসএসসি পাশ এবং দশম শ্রেণীতে পড়ুয়া দুই ছেলে মেয়ের।
‘নিখোঁজ’ লাংকুমার ত্রিপুরা (৪২) খাগড়াছড়ির দীঘিনালার বোয়ালখালি ইউনিয়নের হেডম্যান পাড়ার মৃত পদ্মলাল ত্রিপুরার ছেলে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই সপরিবারে থাকছেন দীঘিনালা ডিগ্রি কলেজের পরিত্যক্ত একটি কক্ষে। তিন সন্তানের জনক লাংকুমার জড়িত ছিলেন পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠন ইউপিডিএফ (প্রসিত) থেকে বিভক্তি হয়ে গঠিত নতুন দল ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) এর সাথে। লাংকুমার জেলা ইউনিটের কর্মী বলে নিশ্চিত করেছেন সংগঠনের এক নেতা।
জানা যায়, গত ২১ এপ্রিল দুপুর থেকে লাংকুমারের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি বন্ধ পায় তার স্বজনরা। সর্বশেষ প্রতিপক্ষের হাতে মৃত্যুর ইঙ্গিত পেয়ে ৫মে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী অন্তেঃষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করেন পরিবারের লোকজন। প্রতিপক্ষের রোষানলে পড়ার ভয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করা হয়নি ঘটনাটি এবং অনেকটা গোপনেই অন্তেঃষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। সে কারণেই বিষয়টি বিলম্বে জানাজানি হয়।
তবে স্বজনদের দাবি, প্রতিপক্ষের হাতে মৃত্যু নিশ্চিত হয়েই অন্তেঃষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে এবং অন্তেঃষ্টিক্রিয়ার খরচের জন্য গণতান্ত্রিক সংগঠনের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকাও দেওয়া হয়েছে পরিবারকে।
শুক্রবার লাংকুমারের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, তার স্ত্রী নদীবালা ত্রিপুরা বাসায় নেই। ৫ বছরের শিশু অভয় ত্রিপুরা মেঝেতে ঘুমাচ্ছে। আর ছোট ভাইকে ঘিরে বসে রয়েছে বড় দুই ভাইবোন। দুই ভাইবোনের চোখে মুখেই যেন বিশাল এক বিশাদের ছায়া ভর করেছে; চেহারায় আতঙ্কের ছাপ।
লাংকুমারের বড় ছেলে পরিষদ ত্রিপুরা (১৫) জানান, তিনি এবার এসএসসি পাশ করেছেন। মেঝো বোন পলিনা ত্রিপুরা পড়ছে ১০ম শ্রেণিতে আর ছোট ভাই অভয়কৃষ্ণ ত্রিপুরার বয়স মাত্র ৫বছর।
পরিষদ আরও জানান, তার বাবা আঞ্চলিক গণতান্ত্রিক পার্টির সাথে জড়িত ছিলেন। ১০-১৫দিন পর পর একবার বাসায় আসতেন। তার দেওয়া খরচে চলতো সংসার এবং তাদের পড়ালেখার খরচ। তার বাবা নিখোঁজ হওয়ার পর এখন ভাই-বোনের পড়া লেখা বন্ধ হয়েছে। তার মা সংসারের খরচ যোগাতে দিনমজুরি করছেন। তারা সারাদিন বাসায় বসে অনিশ্চিত ভবিষতের দুঃশ্চিন্তার মধ্যে থেকে শিশুভাইটিকে দেখাশোনা করেন অসহায় দুই ভাইবোন।
পলিনা জানায়, ২১এপ্রিল (রবিবার) সকাল সাড়ে ৯টার দিকে তার বাবা বাসায় এসে ভাত খেয়ে ঘন্টাখানেক পর আবার চলে যায়। সেদিন দুপুর থেকেই বন্ধ হয়ে যায় লাংকুমারের ফোন। অনেক চেষ্টা করেও তার বাবার আর কোন খোঁজ মেলেনি। এখন পড়ালেখা তো দুরের কথা দুবেলা দুমুঠো ভাতও জোটছেনা তাদের কপালে। ঘরে বসে নিরবে চোখের জল ফেলা ছাড়া মুখ খোলে কাউকে কষ্টের কথা বলারও সাহষ জুটেনা কারো।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্বস্ত একটি সূত্রে জানা যায়, লাংকুমার জেলা ইউনিটের কর্মী হলেও সে রাঙামাটির লংগদু উপজেলা শাখার সহকারী সংগঠক (সেকেন্ড ইন কমান্ড) ছিলেন। সংগঠক ছুটিতে থাকায় ঘটনার সময় তিনি ছিলেন সংগঠকের দায়িত্বে। সে কারণেই ২১এপ্রিল তিনি জরুরিভাবে লংগদু যাচ্ছিলেন। দীঘিনালা-লংগদু সড়ক থেকেই নিখোঁজ হন লাংকুমার।
ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক রিপন চাকমা জানান, ‘লাংকুমার নামে তাদের কোন নেতাকর্মী নিখোঁজ থাকার মতো কোনো খবর তাঁর জানা নেই’
দীঘিনালা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) উত্তম চন্দ্র দেব জানান, ‘পরিবারের পক্ষ থেকে নিখোঁজ বিষয়ে কোন অভিযোগ করা হয়নি।’