ব্রেকিংরাঙামাটিলিড

‘আগে ধর্ষনের হুমকি দিয়েছি,এবার তা বাস্তবায়ন করব’

‘আগে মোবাইল ফোনে ধর্ষণের হুমকি দিয়েছি, এবার তা বাস্তবায়ন করব’ অপহরনকালে এমন হুমকি ও ভয়ের মুখে ছিলেন বলে দাবি করেছেন গত ১৮ মার্চ রাঙামাটির কুতুকছড়ি থেকে অপহৃত হওয়ার পর ১৯ এপ্রিল খাগড়াছড়িতে মুক্তি পাওয়া ইউপিডিএফ সমর্থিত পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের দুই নেত্রী মন্টি চাকমা ও দয়াসোনা চাকমা।

অপহৃত হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মন্টি চাকমা ও রাঙামাটি জেলা সাধারণ সম্পাদক দয়াসোনা চাকমার মু্িক্তর পর রবিবার ঢাকায় ১৯ নারী-ছাত্র-যুব সংগঠনের উদ্যোগে এক সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি করে তারা বলেন, ‘আমরা অকথ্য মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছি, প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবো কিনা নিশ্চিত ছিলাম না। অপহরণ ছিল পরিকল্পিত, নব্য মুখোশবাহিনী ও এমএন লারমা দলের একটি গোষ্ঠী মিলিতভাবে এ ধরনের ঘৃণ্য ন্যাক্কারজনক কাজ করেছে। আন্দোলনের চাপেই তারা আমাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। ছেড়ে দেয়ার আগে নিজেদের অপরাধ আড়াল করতে তারা হাস্যকর নাটক করে, আমাদের দিয়ে ভিডিও রেকর্ডিং করিয়ে তাদের সপক্ষে কথা বলতে বাধ্য করায়। আমাদের সাথে ছবিও তুলেছে। কাছে থেকে আমরা তাদের কা-কারখানা দেখে এসেছি, তাদের হাঁড়ির খবর জেনেছি। তাদের ব্যাপারে আমাদের যে সন্দেহ ছিল, অপহৃত হয়ে আমরা তার চাক্ষুষ প্রমাণ পেয়েছি। আমরা নাটের গুরু আর খেলারামদের চিনে ফেলেছি, যা পর্যায়ক্রমে উত্থাপিত হবে।’

রবিবার সকাল পৌনে ১২টায় ঢাকার সেগুন বাগানস্থ রিপোর্টাস ইউনিটি ভবনের সাগর-রুনি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে ১৯ সংগঠনের পক্ষে সভাপতিত্ব করেন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভানেত্রী নিরূপা চাকমা। সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের সাধারণ সম্পাদক শম্পা বসু, নারী সংহতির সাংগঠনিক সম্পাদক জান্নাতুল মরিয়ম, বাংলাদেশ নারী মুক্তি কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জান্নাতুল ফেরদউস, বিপ্লবী নারী ফোরামের সদস্য আমেনা আক্তার, বিপ্লবী নারী মুক্তির আহ্বায়ক নাসিমা নাজনীন, সিপিবি নারী সেলের সদস্য জলি তালুকদার, বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি বিনয়ন চাকমা, ছাত্র ঐক্য ফোরামের যুগ্ম আহ্বায়ক সরকার আল ইমরান, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি এমএম পারভেজ লেলিন, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি ইকবাল কবীর, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি গোলাম মোস্তফা, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সহ-সভাপতি সাদেকুল ইসলাম, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সদস্য হযরত আলী, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক জিকো ত্রিপুরা প্রমূখ।

১৯ সংগঠনের পক্ষে সংক্ষিপ্ত এক লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন নিরূপা চাকমা। এরপর মন্টি চাকমা তাদের ৩৩ দিনের জিম্মি থাকার দুঃসহ অভিজ্ঞতা লিখিতভাবে সাংবাদিকদের তুলে ধরেন।

মন্টি চাকমা বন্দি থাকাকালীন সেই দুঃসহ দিগুলোর স্মৃতি বর্ণনা করতে যেয়ে বলেন, ১৮ মার্চ সকালে নব্য মুখোশবাহিনীর (ইউপিডিএফ-গনতান্ত্রিক) সন্ত্রাসীরা হঠাৎ ছাত্রদের মেসঘর লক্ষ্য করে ব্রাশ ফায়ার করে। এরপর সবাই দৌড়ে পালাতে থাকে। তখন অন্যদের মতো আমিও সেখান থেকে পালিয়ে একটা শৌচাগারে আশ্রয় নিই। সন্ত্রাসীরা আমাকে দেখে ফেলে। তারা সেখানে যায় এবং বের হয়ে আসতে বলে। আমি আসতে না চাইলে আমাকে গুলি করে মারার ভয় দেখায়। এসময় সেখানে আরেকজন সন্ত্রাসী গিয়ে আমাকে পিছমোড়া করে বেঁধে মারধর করে। পরে ছাত্রদের মেস ঘরে এনে উঠোনের একটা গাছে বেঁধে রাখা হয়। এরপর দয়াসোনা চাকমাকেও সেখানে আনা হয়। পরে দুজনকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে নিয়ে যায়। আমাদেরকে প্রথমে নানিয়ারচরের গুল্যাছড়ি নামক গ্রামে এক পাহাড়ির বাড়িতে রাখা হয়। সেখানে দুইদিন যাবৎ তপন জ্যোতি চাকমা বর্মা আমাদের সাথে খুব খারাপ ভাষায় গালিগালাজ করে ও ধর্ষণের হুমকি দেয়। তিনি এসময় আমাকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে– ‘আগে তোমাকে মোবাইল ফোন করে ধর্ষণের হুমকি দিয়েছি, এবার তা বাস্তবায়ন করব’। পরে ২০ মার্চ একটি ইঞ্জিন বোটে করে নান্যাচর উপজেলা থেকে মহালছড়ি উপজেলায় জেএসএস সংস্কারপন্থীদের ঘাঁটি এলাকা হিসেবে পরিচিত মুবাছড়ি নামক এলাকায় ধনপুদি বাজারে সশস্ত্র প্রহরায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে প্রায় দুই দিন দুই রাত পায়ে হেঁটে দিঘীনালা ও লংগদু সীমান্তবর্তী এলাকা মেরুং-এ নিয়ে জায়গা বদল করে কয়েকটি বাড়িতে জিম্মি করে রাখা হয়।

তিনি আরো বলেন, মূলত তিনটি শর্ত দিয়ে অভিভাবক ও জামিনদারের হাতে আমাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। কোন কোন মিডিয়ায় মুক্তিপণ দেয়ার কথা বলা হলেও, তা সত্য নয়। শর্ত সমূহ এই, (১) রাজনীতি করা যাবে না। (২) নব্য মুখোশবাহিনীর সর্দার বর্মার অনুমতি ছাড়া গ্রামের বাইরে যেতে পারব না। (৩) অপহরণের বিষয়ে কারোর কাছে মুখ খোলা যাবে না। এসব শর্ত ভঙ্গ হলে আমাদের ও অভিভাবকদের কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে।

ছেড়ে দেয়ার দু’দিন আগে ১৭ এপ্রিল তপন জ্যোতি চাকমা বর্মা আমাদের সাথে কথা বলে ছেড়ে দেয়ার ইঙ্গিত দেয়। মুক্তির পর আমরা সংগঠনে যুক্ত থাকতে পারবো না, অন্তত: জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত সাংগঠনিক কাজ কর্ম থেকে আমাদের বিরত থাকতে বলেছিল। সে আমাকে চাকুরী জুটিয়ে দেবে বলেও প্রলোভন দেখায়। এমনও বলে ‘নারী আর কী করবে, বিয়ে করে সংসার করতে হবে’ বলে মন্তব্য করে। তার অনেক কথাবার্তা অসংলগ্ন। ১৮ এপ্রিল সে আবার আমাদের সাথে দেখা করতে আসে। এবার আসে সেজেগুজে নতুন পোশাক পরে, হাতে ছিল একটা সাদা এনড্রয়েড ফোন। আমাদেরকে তার পাশে বসিয়ে অনেকগুলো ছবি তোলে।

পরদিন ১৯ এপ্রিল রাতে আমাদেরকে অভিভাবকের কাছে হাতে তুলে দেয়। দিনের বেলায় আমাদের অভিভাবকদের সাথে অন্য একটা জায়গায় তারা আলাদাভাবে কথা বলে, যা আমরা জানতাম না। ছাড়া পাওয়ার পর আমরা তাদের “শর্তের” কথা জানতে পারি। ২২ এপ্রিল অপহরণকারীরা এমনভাবে সময় মিলিয়ে আমাদের ছেড়ে দেয়, যাতে দিনের বেলা আমরা আমাদের সংগঠনের কারোর সাথে যোগাযোগ করতে না পারি। অভিভাবক ও জনপ্রতিনিধিরা আমাদের নিয়ে যার যার গন্তব্যে রওনা দেন। এলাকায় পৌঁছতে আমাদের রাত হয়ে যায়।

লিখিত বক্তব্যে তিনি আরো বলেন, আমি দেশবাসীর নিকট সত্য ঘটনা তুলে ধরায় আমার পরিবারের উপর সন্ত্রাসীরা ক্ষিপ্ত হয়েছে। আমার বাবা ও বড় ভাইকে তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মা প্রতিনিয়ত মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে। তারা এখন পালিয়ে রয়েছে। আমার পরিবারকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদের ভয় দেখাচ্ছে। শুধু তাই নয়, বর্মা আমাকে যেখানে পাবে সেখানে মেরে ফেলবে বলে আমার মা’কে ফোন করে হুমকি দিয়েছে। আমার ও দয়াসোনার পরিবার চরম নিরাপত্তহীনতায় রয়েছে।

সংবাদ সম্মেলন থেকে ১৯ নারী-ছাত্র-যুব সংগঠনের পক্ষে থেকে ৮ দফা দাবি জানানো হয়। (১) অনতিবিলম্বে অপহরণকারী দুর্বৃত্তদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান। (২) মন্টি ও দয়াসোনা চাকমার পরিবারের নিরাপত্তা বিধান। (৩) অপহরণকারী ও তাদের মদদ দাতাদের গ্রেফতার ও বিচার করতে হবে। (৪) পাহাড় ও সমতলে সংঘটিত সকল ধর্ষণ-গুম-খুন-অপহরণের বিচার করতে হবে। (৫) পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অঘোষিত সেনা শাসন প্রত্যাহার করতে হবে। (৬) পার্বত্য চট্টগ্রামে ধরপাকড়, নিপীড়ন নির্যাতন হয়রানি বন্ধ করতে হবে। (৭) সন্ত্রাসী অপকর্মে রাষ্ট্রীয় মদদদান বন্ধ করতে হবে। (৮) পাহাড় ও সমতলে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

সংবাদ সম্মেলন থেকে ১৯ নারী-ছাত্র-যুব সংগঠনসমূহের নেতৃবৃন্দ অপহরণকারীদের গ্রেফতারে প্রশাসনের কোন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছেনা উল্লেখ করে বলেন, অপহরণের ৫ দিন পর দয়াসোনা চাকমার বাদী হয়ে রাঙামাটির কোতয়ালী থানায় আসামীদের সুনির্দিষ্ট নাম ও ঠিকানা উল্লেখ করে মামলা করলেও পুলিশ এখনো কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। এমনকি অপহরণ ও মামলার বিষয়ে কোন তৎপরতাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এমনকি তারা মুক্তি পাওয়ার পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনো কোন খোঁজ-খবর নেয়া হয়নি। এতেই প্রমাণিত হয় অপহরণের ঘটনায় বিশেষ শক্তিশালী গোষ্ঠী বা প্রশাসনের যোগসাজশ রয়েছে।

এই বিভাগের আরো সংবাদ

১টি কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

4 × 3 =

Back to top button