আইনের তোয়াক্কা না করে খাগড়াছড়ি জেলা সদরের ঠাকুরছড়া এলাকায় একটি ইটভাটা নির্মাণ করা হচ্ছে । অবৈধভাবে নির্মিনাধীণ এই ইটভাটা ঘিরে রয়েছে বেশ কয়েকটি গ্রাম, ঐতিহ্যবাহী মং রাজবাড়ী, ৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ১টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। যদিওবা ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রন) আইন ২০১৩ তে বলা আছে, এমন কোন প্রতিষ্ঠান থাকলে তার এক কিলোমিটারের মধ্যে কোন ইটভাটা থাকতে পারবেনা।
ইতোমধ্যে নির্মাণাধীন ইটভাটা স্থাপন বন্ধে রাজপরিবারসহ স্থানীয়রা প্রশাসনের কাছে লিখিত আবেদন করলেও ভাটার মালিক মো. সেলিম প্রভাবশালী ঠিকাদার হওয়ায় দিব্যি নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, খাগড়াছড়ির ঠাকুরছড়া এলাকায় রাঙামাটি সড়কের পাশ ঘেঁষে কৃষি জমির ওপর এস্কেভেটর দিয়ে মাটি খননের কাজ চলছে। নির্মানাধীণ এই ইটভাটার উত্তরে রয়েছে মহালছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, খাগড়াছড়ি পিটিআই, পিটিআই পরীক্ষণ বিদ্যালয়, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। তার একটু দূরেই রয়েছে মং সার্কেলের রাজবাড়ি। দক্ষিনে কয়েকশ গজের মধে রয়েছে ঠাকুরছড়া গোলাবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয় ও শতবর্ষী ঠাকুরছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ইটভাটার পশ্চিমে অর্থ্যাৎ খাগড়াছড়ি-রাঙামাটি সড়কের ডান পাশে পাহাড়ে রয়েছে মারমাদের বসতি, শতবর্ষী বৌদ্ধ বিহার এবং পূর্বে রয়েছে চেঙ্গী নদীর অববাহিকায় প্রথম শ্রেনীর ফসলী জমি।
এদিকে, নির্মানাধীন ইটভাটার জমি নিয়ে আছে বিতর্ক। এই ইটভাটার মধ্যে স্থানীয় ও সড়ক বিভাগের জায়গা বেদখলের অভিযোগ রয়েছে। ইতিমধ্যে এই ইটভাটার নির্মাণ কাজ বন্ধ করার জন্য মং রাজ পরিবারসহ ১শ ৭জনের স্বাক্ষরিত একটি আবেদন জেলা প্রশাসকের কাছে দেয়া হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা থৈ প্রু চাই মারমা ও সুইচিংহ্লা চৌধুরী জানান, ‘এমনি একটি জায়গার মধ্যে ইটভাটা নির্মাণ করা হচ্ছে যেটি কিনা প্রথম শ্রেনীর কৃষি জমি। যার চারপাশে রয়েছে প্রায় ৫শতাধিক মারমা ও ত্রিপুুরা জনগোষ্টীর বসতি। ইটভাটার সামনে রয়েছে একটি টিউবওয়েল। যেটির উপর আশপাশের প্রায় ৪০ থেকে ৫০ পরিবার নির্ভরশীল। এখন ইটভাটা হলে টিউবওয়েলটি ব্যবহার করতে পারবেনা।’
ঠাকুরছড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেনীর ছাত্র শাকিল ত্রিপুরা ও ৭ম শ্রেনীর ছাত্রী নিলাবাই মারমা জানায়, ‘আমরা বইয়ে পড়েছি বায়ু দুষণের কারণে পরিবেশ নষ্ট হয়। এখন আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশে এমন ইটভাটা নির্মাণ হচ্ছে দেখে আমরা শঙ্কিত। ইটভাটার ফলে কালো ধোয়ায় পরিবেশ নষ্ট হবে।’
ঠাকুরছড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কার্নেজী চাকমা ও ঠাকুরছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক দিপা ত্রিপুুরা জানান, ‘একজনের জন্য কতজনের ক্ষতি হতে যাচ্ছে সেটি আমাদের চিন্তা করা উচিৎ। লোকালয়ের মাঝখানে এই ইটভাটা কোন অবস্থায় গ্রহণযোগ্য নয়। বিশেষ করে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়বে। নষ্ট হবে এখানকার পরিবেশ। তাই এই ইটভাটা নির্মাণ বন্ধে তাঁরা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।’
মং সার্কেলের রাজমাতা মাধবীলতা চৌধুরী বলেন, ‘যেখানে ঐতিহ্যবাহী রাজবাড়ী, একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক প্রশিক্ষন কেন্দ্র, গ্রাম, শত বছরের পুরনো বৌদ্ধ বিহার আছে সেখানে কোন অবস্থায় ইটভাটা হতে পারেনা। ইটভাটা হলে এলাকার কৃষি জমিসহ স্থানীয় জীবনযাত্রায় বিরূপ প্রভাব পড়বে। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে বিষয়টি জানিয়েছি। আমার বিশ্বাস ইটভাটা নির্মাণ বন্ধে তারা ভূমিকা রাখবে।’
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রন) আইন, ২০১৩ এর ৮(১) ধারাতে উল্লেখিত সব শর্তের ব্যত্যয় ঘটছে এই ইটভাটা নির্মাণে। আইনের ধারা ও উপধারায় বলা আছে, আবাসিক, বাণিজ্যিক, উপজেলা সদর, কৃষি জমি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এলাকার এক কিলোমিটারের মধ্যে কোন ভাবেই ইটভাটা স্থাপনের অনুমোদন পাবেনা। আইনের এসব ধারা উপধারা লংঘন করলে সর্বনি¤œ ৫ বছরের কারাদন্ড বা ৫ লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত করার বিধান রয়েছে।
এই বিষয়ে জানতে ঠিকাদার মোঃ সেলিমের সাথে সাংবাদিকরা মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি উল্টো বলেন, ‘খাগড়াছড়িসহ তিন পার্বত্য জেলার কোন ইটভাটার অনুমোদন নেই। তিনি সাংবাদিককে সরাসরি দেখা করার প্রস্তাব দেন।’
খাগড়াছড়ি পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলন কর্মী সাংবাদিক প্রদীপ চৌধুরী বলেন, ‘এমনিতে পরিবেশ নিয়ে যত আইন আছে স্থানীয় প্রশাসন তার কোনো কিছুই ফলো করেনা। ঠিকাদার সেলিমের বিরুদ্ধে পুকুর ভরাট, ছড়া দখল, শুকনো মৌসুমে প্রকাশ্যে নানা অজুহাতে মাটির টপসয়েল কেটে নিয়ে যাওয়া, ইটভাটায় কাঠ পোড়ানোসহ অজ¯্র অভিযোগ রয়েছে। আর সবই করছে প্রশাসনকে ম্যানেজড করে। যদি এ ইটভাটা নির্মাণ কাজ দ্রুত বন্ধ করা না হয়; আমরা পরিবেশকর্মীরা দ্রুত আন্দোলনে নামবো।’
খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শামছুল তাবরীজ বলেন, ‘এই ইটভাটার বিরুদ্ধে এলাকাবাসীর লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। এটি নির্মাণে কোন অনুমোদন চাওয়া হয়নি। আগামী দুই একদিনের মধ্যে এই ইটভাটা নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয়া হবে।’