মহামারি করোনাভাইরাস এলোমেলো করে দিয়েছে সবকিছু। যতটুকু জীবনযাত্রা স্বাভাবিক আছে তাও সামাজিক দূরত্ব মেনে। দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ঘরে বসে যতটুকু পড়াশোনা করানো যায় সেই চেষ্টায় চালাচ্ছে মা-বাবা। আর এমন চেষ্টায় আশার আলো সঞ্চার করছে ক’জন। খাগড়াছড়ির পানছড়িতে অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ঘরে বসে পড়ানোর অভিনব উদ্যোগ নিয়েছে এক দল তরুণ-তরুণী।
কলেজ, বিশ^বিদ্যালয়ে পড়–য়া তরুণরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্লাস নিচ্ছে। ঘরে বসেই যার সুফল পাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। যদিও খাগড়াছড়ির বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা অনলাইনে ক্লাস নিলেও বিনা বেতনে স্থানীয় তরুণদের এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাচ্ছে সকলে।
জানা যায়, পানছড়ির স্থানীয় তরুণ মিঠুন সাহা ফেসবুকে পানছড়ি অনলাইন ক্লাস নামে একটি আইডি খুলে। পরবর্তীতে স্থানীয় তরুণ-তরুণীদের সাথে নিয়ে গত ১৩জুন থেকে শুরু করে অনলাইনে ক্লাস নেয়া। বিভিন্ন কলেজ, বিশ^বিদ্যালয়ে পড়–য়া এসকল তরুণ-তরুণীদের সাথে স্থানীয় বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরাও যুক্ত হয়েছেন। মিঠুন সাহার বাড়ি থেকে ফেসবুক লাইফের মাধ্যমে ক্লাসগুলো পরিচালিত হয়। মোট ১৮জন কলেজ, বিশ^বিদ্যালয়ে পড়–য়া তরুণ তরুণীসহ মোট ২৩জন শিক্ষক ক্লাসগুলো নিয়ে থাকেন।
অনলাইন ক্লাসে নেয়া চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজের মানবিক বিভাগের একাদশ দ্বাদশের শেষ বর্ষের ছাত্রী হেমা চাকমা বলেন, একান্ত দ্বায়িত্ববোধের জায়গা থেকে আমি ক্লাস নিচ্ছি। স্কুল, কলেজ বন্ধ, বাইরে গিয়ে পড়ারও সুযোগ নেই। তাই অনলাইনের মাধ্যমে ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো ছড়াতে আমার অনেক ভালো লাগছে। পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেনী পর্যন্ত গণিত, ইংরেজী ১ম ও ২য় পত্র, বাংলা ১ম ও ২য় পত্র, হিসাব বিজ্ঞান, তথ্য ও প্রযুক্ত, ফিনেন্স ব্যাংকিং ও বীমা, ব্যবসায় উদ্যোগ, পদার্থ বিদ্যা, রসায়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে পড়ানো হয়। শুক্রবার বাদ দিয়ে সপ্তাহে ৬দিন এবং দিনে ৫টি করে ক্লাস নেয়া হয়। স্থানীয় ক্যাবল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তা সম্প্রচার করা হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োটেকনোলজি বিভাগের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র উচ্ছ¡াস সিকদার বলেন, যখন সবধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য যখন বন্ধ তখন এই ধরনের উদ্যোগ যথেষ্ট সহায়ক এবং সময়োপযোগী। তাছাড়া আমরাও চাই পরিশ্রম, নিষ্ঠা এবং বৈচিত্রতার মাধ্যমে ক্লাস নিতে। যাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহ তৈরি করতে পারি।
স্থানীয় ব্যবসায়ী ও অভিভাবক সমীর সাহা বলেন, দেশের এই দুর্দিনে তরুণ-তরুণীরা এমন সেবামূলক শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন তা সত্যিই প্রশংসার। তারা সকলে ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। আমার ছেলে ও মেয়ে প্রতিদিন টেলিভিশনের মাধ্যমে ক্লাস গুলো দেখি। এতে তারা খুবই উপকৃত হচ্ছে।
পানছড়ি অনলাইন ক্লাসে নবম দশম শ্রেণির গণিত বিষয়ে পাঠ নেওয়া পানছড়ি বাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিখিল চৌধুরী বলেন, শুরুতে আমার একটু আশঙ্কা ছিল যে তাদের উদ্যোগ কতটুকু সফল হবে। কিন্তু তাদের ক্লাস নেওয়ার ধরণ দেখে আমার মনে ভরসা জাগলো। আমি নিজেও এখানে ক্লাস নেয়। দেশের ক্রান্তিলগ্নে ছাত্রছাত্রীদের কল্যাণে তাদের এমন উদ্যোগ অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয় বলে আমি করি।
অন্যদিকে পানছড়ি বাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের আরেকজন সহকারী শিক্ষক প্রভাষ রয় বলেন, বিনা স্বার্থে নিঃস্বার্থভাবে তারা অক্লান্ত সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এর উদ্যোগক্তা মিঠুন সাহা আন্তরিক ভাবে অনার্স মাস্টার্স পড়ুয়া তরুণ তরুণীদের নিয়ে যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে চমৎকার ভাবে পাঠদান দিয়ে যাচ্ছে। আমিও এই অনলাইন ক্লসে সপ্তাহে তিন দিন ক্লাস নিচ্ছি।
পানছড়ি অনলাইন ক্লাসের উদ্যোক্তা মিঠুন সাহা বলেন, সব শিক্ষার্থী যেহেতু ঘরবন্দি তাই ভাবলাম অনলাইনে ক্লাস নিয়ে দেখি কেমন হয়। এতে স্থানীয়দের ব্যাপক সারা পাই। পরবর্তীতে আস্তে আস্তে পরিধি বাড়তে থাকে। বিদ্যালয়ের শিক্ষক, কলেজ, বিশ^বিদ্যালয়ে পড়–ুয়ারা নিজ আগ্রহে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ক্লাস নিতে শুরু করে। আমাদের এমন কাজে যদি ঘরে বসে শিক্ষা অর্জন করতে পারে তাহলে সেটিই আমাদের স্বার্থকতা।