খেলাতে তাঁর সবচেয়ে বেশি সাফল্য সেটা খেলতে শুরু করেছেন সবার পরে। দৌড়, জিমন্যাস্টিকস ইত্যাদি শেষ করে জুডোতে এসে টানা সাফল্যের সুবাদে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার। কিন্তু খুরশিদা আকতার খুশীর ক্যারিয়ার বিশ্লেষণ করলে এ সাফল্যের মতোই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে আরেকটা ছবি। তখনকার সমাজের উদারতা। তিনি বা তাঁর মতো মেয়েরা নানা খেলাধুলায় অংশ নিচ্ছে; কিন্তু পরিবার বা সমাজ বাধা হচ্ছে না—এটা যেন অন্য এক বাংলাদেশের ছবি। নিজের সঙ্গে সঙ্গে সেই ছবির গল্পও শোনালেন তিনি, শুনলেন নোমান মোহাম্মদ
প্রশ্ন : আপনার চোখে একটা সমস্যা আছে বলে শুনেছি। এবারও সাক্ষাৎকার নেওয়ার আগে যতবার ফোনে কথা হয়েছে, বারবার চোখের সমস্যার কথা বলেছেন। সমস্যাটা কী?
খুরশিদা আকতার খুশী : আমি তো ভাই অন্ধ।
প্রশ্ন : পুরোপুরি অন্ধ!
খুশী : পুরোপুরিই অন্ধ ছিলাম। এখন ডান চোখ ভালো; কিন্তু বাঁ চোখে কিছুই দেখি না। অথচ জানেন, আমার দুটো চোখই ভালো হয়ে গিয়েছিল।
প্রশ্ন : আপনার খেলোয়াড়ি কীর্তির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, তবু ব্যক্তিগত জীবনের এ ট্র্যাজেডি দিয়েই শুরু করতে চাই সাক্ষাৎকার। কিভাবে এত সব হলো, সেই করুণ গল্পটি যদি বলেন…
খুশী : অন্ধ হওয়ার সঙ্গে কিন্তু খেলার সম্পর্ক রয়েছে। সে কারণে এটি অপ্রাসঙ্গিক মনে হবে না। ২০০০ সালের মাঝামাঝি সময়ের ঘটনা সেটি। মিরপুরে বাচ্চাদের এক জুডো প্রতিযোগিতায় খেলা চালানো শেষে আমি ও আরেক বিখ্যাত জুডোকা কামরুন নাহার হীরু ফিরছিলাম বেবিট্যাক্সিতে। পেছনে থেকে একটা বড় পাজেরো গাড়ি এসে মেরে দেয়। রাস্তায় পড়ে যাই আমরা। হাত-পা ছিলে যায়, মাথার পেছন দিকে আমি ব্যথা পাই একটু—এ ছাড়া তেমন বড় কিছু হয়নি বলে মনে হয়। কিন্তু আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর অধ্যায়ের শুরু যে ছিল সেটি, বুঝতে পারিনি।
প্রশ্ন : বুঝতে পারেন কখন?
খুশী : ওই বয়সেও যে খেলা নিয়ে পড়ে থাকি, ট্রেনিং-টুর্নামেন্ট শেষ করে বাসায় ফিরতে কখনো কখনো যে রাত হয়ে যায়, তা আমার স্বামী পছন্দ করত না। (পাশে বসা স্বামীকে দেখিয়ে) ভালো কথা, আমার স্বামী মীর রবিউজ্জামান নিজেও কিন্তু ভালো জিমন্যাস্ট ছিল। জাতীয় পর্যায়ে স্বর্ণপদক পেয়েছে, পেয়েছে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির পুরস্কার। যাহোক, ওর ভয়ে অ্যাক্সিডেন্টের খবরটা বাসায় বলিনি। মাথায় ব্যথা পাওয়ার জায়গায় নিজে নিজে পণ্ডিতি করে পানি-বরফ দিয়েছি—ব্যস। কিছুদিন পর দেখি, চোখে কেমন সব ঘোলা ঘোলা লাগে। পরিস্থিতি খুব দ্রুত খারাপ হচ্ছে দেখে স্বামীকে না বলে উপায় থাকে না। যাই ডাক্তারের কাছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানতে পারি, চোখের রেটিনা পুরোপুরি ভেঙে চুরমার। মাথায় পেছনের দিকের সঙ্গে নাকি চোখের নার্ভের কী রকম যোগাযোগ রয়েছে। সেই দুর্ঘটনার খুব অল্প সময়, ধরুন মাস ছয়েকের মধ্যে অন্ধ হয়ে যাই আমি।
প্রশ্ন : বলেন কী!
খুশী : হ্যাঁ, এত তাড়াতাড়ি যে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটে যাবে—সে জানত! ২০০১ সালে ফেব্রুয়ারিতে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় ভারতের চেন্নাইয়ে, শংকর নেত্রালয়ে। ওখানকার চিকিৎসায় উন্নতি বলতে, দিন আর রাতের পার্থক্যটা একটু একটু বুঝতে পারতাম। চোখে দিনের আলো টের পেতাম আবছা। এর চেয়ে বেশি কিছু না। ওষুধের প্রভাবে মাথার চুল পড়ে যায়, মোটা হয়ে যাই খুব। কিন্তু ডাক্তাররা জানিয়ে দেন, চোখ ভালো হওয়ার সম্ভবনা নেই।
প্রশ্ন : আপনি না বলছিলেন, দুটো চোখই ভালো হয়ে গিয়েছিল…
খুশী : সেটাই তো মিরাকল। ঘটনাটি না বললে বুঝতে পারবেন না। আমি তো ভাই জন্মান্ধ না, সুস্থ-স্বাভাবিক একজন মানুষ। সেই সত্তর-আশির দশকে জাতীয় পর্যায়ে বর্শা নিক্ষেপে অংশ নিই, জিমন্যাস্টিকসে পদক জিতি আর জুডোতেও জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হই পাঁচবার। মাঠ দাপিয়ে বেড়ানোর পর ১৯৮১ সাল থেকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোচ হিসেবে আছি। সারা জীবন মাঠে কাটিয়ে দেওয়া এমন একজন মানুষ হঠাৎ অন্ধ হয়ে গেলে কী হয়, তা বলে বোঝানো যাবে না। আমার মেয়ে রিখি তখন পড়ছে ভিকারুননিসায়। সব মিলিয়ে পাগল পাগল অবস্থা। ওই সময় আমার স্বামীর এক পীর বাবা রয়েছেন, তিনি আমার চোখ ভালো করে দেন।
প্রশ্ন : পীর বাবা!
খুশী : সত্যি বলতে কী, এসব নিয়ে আমার কোনো বিশ্বাস ছিল না। এক রকম মরিয়া হয়েই ওনার কাছে যাই। পীর বাবা আমাকে বলেন, ‘রিখির মা, আপনি তো আমাকে বিশ্বাস করেন না, তাহলে কাজ হবে কিভাবে?’ জবাব দিই, ‘বাবা, আপনি যদি বলেন দিন, তাহলে দিন। যদি বলেন রাত, তাহলে রাত। যা বলবেন, তা-ই হবে। শুধু আমার চোখ ভালো করে দিন। ’
প্রশ্ন : অন্ধ হওয়ার কারণেই ওই অন্ধবিশ্বাসটা করলেন?
খুশী : এ ছাড়া আমার কোনো উপায় ছিল না। এরপর ওই পীর বাবা গাছের পাতা, মাটি এবং আরো কী কী সব চোখে দেওয়া শুরু করেন। সঙ্গে দোয়া-দরুদ। শুরুতে খুব যন্ত্রণা হয়, পরে আরাম। মাস ছয়েক পর হঠাৎ একদিন খেয়াল করি আমার চোখে দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসছে। পীর বাবার সাদা লুঙ্গির সবুজ পাড় পাচ্ছি দেখতে। এই আস্তে আস্তে ভালো হয়ে যাই আমি।
প্রশ্ন : এরপর আবার বাঁ চোখ নষ্ট হয় কিভাবে? তখন ওই পীর বাবা কিছু করতে পারেননি!
খুশী : এটি হয়েছে ডাক্তারদের অবহেলায়। আমার স্বামী তা ভালো বলতে পারবেন। (বলা শুরু করেন মীর রবিউজ্জামান, ‘‘আমার ওই স্পিরিচুয়াল ফাদার সব সময় বলতেন, খুশীকে এক চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রাখতে। উনারা কী বলেন, সেটি তাঁকে জানাতে। আমরা তাই করতাম। ওর চোখ ভালো হয়ে যাওয়ার কিছু দিন পর ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় চোখে হয়ে যায় গ্লুকোমা। কিন্তু ডাক্তাররা তা ধরতে পারেননি। ফলে খুশীর একটা চোখ নষ্ট হয় ২০০২ সালের শুরুতে। হুজুর তা আবার ঠিক করতে পারেননি কেন জিজ্ঞেস করলেন তো? ওনাকে বলেছিলাম। উনি বললেন, ‘দেখো, দুটো চোখ পুরো নষ্ট ছিল, তখন আমি নানাভাবে চেষ্টা করে ভালো করেছি। এত কিছু দিয়েছি; কিন্তু কোনটিতে যে কাজ হয়েছে, তা তো জানি না। এখন ওর একটি চোখ ভালো আছে। এখানে নতুন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গেলে যদি ওই চোখও নষ্ট হয়ে যায়!’ সে কারণে উনি আর কিছু করেননি। ’’)
প্রশ্ন : এই এক চোখ নিয়েই আপনি পরবর্তী সময়ে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোচের চাকরি চালিয়ে গেলেন। অসুবিধা হয়নি?
খুশী : অফিস থেকে সমর্থন না পেলে হতো। কিন্তু কিভাবে যে সবাই আমাকে আগলে রেখেছেন! আমি চাকরি ছাড়তে চেয়েছি, ওনারা ছাড়তে
দেননি। পরে বললেন, ‘অনেক দিন তো মাঠে-ঘাটে দৌড়ালেন। এবার অফিসের চেয়ারে বসে এখানকার কাজকর্ম করুন। ’ যখন সুস্থ ছিলাম, তখন কাজ করেছি মেশিনের মতো। অফিস তা মনে রেখেছে। আমার বাসা ছিল নয়াপল্টনে; সেখান থেকে ক্রীড়া পরিষদ ১০ মিনিটের পথ। এমনও হয়েছে, এক ডেকচি পানির মধ্যে মটরডাল চুলায় বসিয়ে বাচ্চাদের কোচিং করিয়ে এসেছি। ওই মটরডাল সিদ্ধ হতে যে এক-দেড় ঘণ্টা লাগে, সে সময়টাও নষ্ট করিনি। চোখ খারাপ হওয়ার পরও আমি বাচ্চা মেয়েদের ট্রেনিং দিয়েছি। কিন্তু বেশির ভাগ কাজ করি অফিসে বসেই। সে কারণে দেখুন, ওই কবে ২০০০ সালে দুর্ঘটনাটি হয়েছে। এর পরও এত বছর চাকরি করে এখন আমি এলপিআরে। অফিসের প্রতি, ওখানকার মানুষগুলোর প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার তাই শেষ নেই।
প্রশ্ন : ভীষণ মন খারাপ করে দেওয়া এক ঘটনা দিয়ে সাক্ষাৎকারটি শুরু হলো। এবার শুনতে চাই মন ভালো করে দেওয়ার গল্পগুলো। কিভাবে খেলাধুলার এই জগতে এলেন, কিভাবে সাফল্য ধরা দিতে শুরু করে আপনার কাছে, সেসব…
খুশী : আপনি রাজিয়া সুলতানা অনুর নাম শুনেছেন না?
প্রশ্ন : হ্যাঁ, কালের কণ্ঠ’র এই সাক্ষাৎকার পর্বের জন্য ওনার সাক্ষাৎকার নিয়েছি। গেল ফেব্রুয়ারি মাসেই তা ছাপা হয়েছে।
খুশী : তাহলে তো ওকে চেনেনই। অনুর হাত ধরেই আমি এসেছি খেলাধুলায়। আমার জন্ম চট্টগ্রামে। সাত ভাই, চার বোনের মধ্যে আমি ৪ নম্বর। মায়ের নাম মরিয়ম নেসা বেগম। বাবা আবদুল হামিদ ব্রিটিশ আমলে সেনাবাহিনীতে ছিলেন। পরে চাকরি করেন রেলওয়েতে। কমলাপুর স্টেশনের হেড গুডস ক্লার্ক হিসেবে অবসরে যান। আমরা থাকতাম শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনির একই বিল্ডিংয়ে—চারতলায় আর একতলায়। ছোটবেলায় আমি খুব টিংটিঙে ছিলাম। আমার বড় ভাই সালাউদ্দিন একদিন অনুকে বলল, ‘ও তো ভীষণ রোগা। তোমরা দৌড়াতে যাওয়ার সময় ওকে নিয়ে যেও। তাতে যদি স্বাস্থ্য একটু ভালো হয়। ’ অনু তখনই ভালো অ্যাথলেট। দৌড়বিদ ছিল তো, সারা দিন রাস্তায় রাস্তায় দৌড়ায়। ওদের সঙ্গে আমারও শুরু হলো দৌড়ানো।
প্রশ্ন : কিন্তু আপনি তো পরে দৌড়ে জাতীয় পর্যায়ে অংশ নেননি?
খুশী : কারণ দৌড় আমার ভালো লাগত না। কী সারা দিন ঢাকা শহরের বিভিন্ন রাস্তায় দৌড়ানো! তবু জগন্নাথ কলেজের দৌড়ে নাম লেখাই। কিন্তু অনু-টলির সঙ্গে পারা যায় নাকি? অনু তখন করে কী, আমার হাতে বর্শা ধরিয়ে দেয়। বলে, ‘দৌড় তো পারবা না, দেখো বর্শা নিক্ষেপে পারো কি না। ’ ওটা দেখি একটু একটু পারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার প্রথমও হই। আর জাতীয় পর্যায়ে বিটিএমসি থেকে অংশ নিয়ে বোধ হয় তৃতীয় হয়েছিলাম।
প্রশ্ন : এ বর্শা নিক্ষেপও তো পরে চালিয়ে যাননি?
খুশী : না। চলে আসি জিমন্যাস্টিকসে। সময়টা ১৯৭৪ সাল। আমার স্বামী তখন জিমন্যাস্টিকসে জাতীয় পর্যায়ে স্বর্ণপদক জিতেছে। কিন্তু আমাদের তখনো বিয়ে হয়নি। রবি এবং ওর দুই বন্ধু দীপু ও নাসির আমাকে একদিন বলে, ‘তোমার জন্য অ্যাথলেটিকসের চেয়ে জিমন্যাস্টিকস ভালো হবে। খেলবে তুমি?’ খেলব কী, আমি ওই খেলার নামই কোনো দিন শুনিনি। তখন ওরা তিনজন শুরু করে পটানো। আমি করলাম কী, অনু আর টলিকে নিয়ে যাই এনএসসির জিমন্যাস্টিকস অনুশীলনে। কাজী আবদুল আলিম ভাই তখন ওখানকার কোচিং সেন্টারের পরিচালক। তাঁর ওখানে গিয়ে শুরু করি জিমন্যাস্টিকস। বাংলাদেশে মেয়েদের মধ্যে আমি, অনু আর টলিই প্রথম আসি জিমন্যাস্টিকসে; আরেকটা মেয়ে ছিল নওরোজ নামে। অনু-টলিরা আসলে আসে আমাকে উৎসাহ দিতে। আমাকে জিমন্যাস্টিকস ধরিয়ে ওরা চলে যায় নিজেদের ইভেন্ট দৌড়ে।
প্রশ্ন : জিমন্যাস্টিকসে তো সাফল্য পেয়েছেন বেশ?
খুশী : আমি ওই ১৯৭৪ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত জিমন্যাস্টিকস করি বিটিএমসির হয়ে। অংশ নিই চারটি ইভেন্টে—ফ্লোর এক্সারসাইজ, ব্যালান্স বিম, সাইডহর্স এবং আনইভেন বার। সাফল্য খারাপ না। মেট্রোপলিস প্রতিযোগিতায় একটি স্বর্ণপদক জিতি; দুটো রৌপ্য। জাতীয় পর্যায়ে কোনো স্বর্ণপদক জিততে পারিনি। তবে ছয়টি করে রৌপ্য-ব্রোঞ্জ আছে। সমস্যা হচ্ছে কী, জিমন্যাস্টিকসে তো ছোট ছোট মেয়েরা ভালো করে। ওদের শরীরের স্ট্রেচিং-ফ্লেক্সিবিলিটি থাকে অনেক বেশি। আমাদের সময় মনিরা বিল্লাহ খান মজলিস যেমন দারুণ সহজাত জিমন্যাস্ট ছিল। আমি এই ইভেন্টে এসেছি বেশ পরে; ইন্টারমিডিয়েট পাস করে। যদি জিমন্যাস্টিকসে আরো ছোটবেলায় আসতাম, তাহলে আরো অনেক বেশি সাফল্য পেতাম।
প্রশ্ন : জিমন্যাস্টিকসের তো আলাদা পোশাক রয়েছে। সত্তরের দশকে ওই পোশাক পরে খেলাটা কত কঠিন ছিল?
খুশী : অন্যরা কী বলবে, তা বাদ দিন। আমি নিজেই তো একটু রক্ষণশীল ধরনের। অনু-টলিদের সঙ্গে দৌড়ের সময় যখন দেখতাম, ছেলে-মেয়ে সবাই একসঙ্গে দৌড়াচ্ছে—ব্যাপারটা কেমন কেমন লাগত! অথচ এই আমিই পরে জিমন্যাস্টিকস কস্টিউম পরে প্রতিযোগিতা করেছি। আসলে তত দিনে খেলার এই জায়গাটাকে ভালোবেসে ফেলেছি আমি।
প্রশ্ন : সমাজের রক্ষণশীলতার চোখ রাঙানি ছিল না?
খুশী : তেমন একটা না। আর পরিবার থেকে সমর্থন থাকায় আমার সমস্যা হয়নি। আমি তো বলব, তখনকার চেয়ে এখন সমাজে গোঁড়ামি অনেক বেশি। অনু-টলিদের সঙ্গে ঢাকা শহরে এমন কোনো রাস্তা নেই, যেখানে আমরা দৌড়াইনি। আমাদের সঙ্গে দু-তিনজন ছেলেও থাকত। এখনকি ইন্টারমিডিয়েট পড়ুয়া তিন-চারজন মেয়ে ঢাকা শহরের রাস্তায় দৌড়াতে পারবে? পারবে না। এখন বরং মোল্লাগিরি অনেক বেশি হয়ে গেছে। (পাশ থেকে যোগ করেন তাঁর স্বামী রবিউজ্জামান, ‘আমরা তো জিমন্যাস্টিকসের কস্টিউম পরিয়ে মেয়েদের অনেক প্রতিযোগিতা করিয়েছি। কোনো বাধা আসেনি। পরে এরশাদ সাহেব এনএসসির প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর নির্দেশ দিলেন, এমন পোশাকে জিমন্যাস্টিকস করানো যাবে না। ’)
প্রশ্ন : মেয়েদের খেলাধুলার ব্যাপারে তখনকার চেয়ে এখনকার সমাজ যে বেশি এগোয়নি; তা কিন্তু কালের কণ্ঠ’র এই সাক্ষাৎকার পর্বে কামরুন নাহার হীরুও বলছিলেন…
খুশী : ঠিক তা-ই। আমার বরং নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়। খুব একটা প্রতিবন্ধকতা তখন ছিল না। বাসা থেকে সমর্থন পেয়েছি সব সময়। বিয়ের পর উৎসাহ পাই স্বামীর কাছ থেকে। ও তো এ খেলারই লোক, আমাদের ব্যাপারটি বুঝত। এমনকি তখনকার সাংবাদিক ভাইদের কাছ থেকেও উৎসাহ পেয়েছি সব সময়। কামরুজ্জামান ভাই, বদি-উজ-জামান ভাই, আতাউল হক মল্লিক ভাই— কতজনের কথা মনে পড়ে। কামরুজ্জামান ভাই তো আমার সঙ্গে দেখা হলেই গান গাইতেন, ‘মন যে খুশি খুশি আজ। ’ সবাই আদর করতেন আমাদের। আরেকটি ব্যাপার। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকেই আমরা কয়েকজন মেয়ে খেলোয়াড় কোটায় চাকরি পেয়ে যাই বিটিএমসিতে। একইভাবে আমি ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। এত কম বয়সে চাকরি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া, সঙ্গে পছন্দের খেলা খেলতে পারা—সব মিলিয়ে তা ছিল দারুণ ব্যাপার।
প্রশ্ন : আপনি তো জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পেয়েছেন জুডোতে। অথচ দেখতে পাচ্ছি, দৌড়ে শুরুর পর বর্শা নিক্ষেপ হয়ে জিমন্যাস্টিকসে চলে এসেছে কথোপকথন। এখনো জুডোতে আসছে না!
খুশী : কারণ জুডো আমি শুরু করি সবার শেষে। জিমন্যাস্টিকস শুরুরও এক-দুই বছর পর। দুটোই পাশাপাশি চালিয়ে যাই অনেক দিন। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে জিমন্যাস্টিকসে পারফরম্যান্স পড়ে যেতে থাকে আর ভালো হতে থাকে জুডোতে। আসলে ওই যে অনু-টলিদের সঙ্গে দৌড়েছি, সেই দমটা তখন কাজে লাগল খুব। বিভিন্ন প্রতিযোগিতার পাশাপাশি জাতীয় পর্যায়েও শুরু করি স্বর্ণপদক পাওয়া। জুডোতে জাতীয় পর্যায়ে পাঁচটি স্বর্ণপদক জিতি আমি। খেলেছি আনসার দলে।
প্রশ্ন : জুডোতে কামরুন নাহার হীরু তো টানা ১০ বারের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। তাঁর সঙ্গে লড়াই হতো না?
খুশী : না, ওর আর আমার ওজনশ্রেণি আলাদা। প্রথমবার না বুঝে একসঙ্গে খেলেছি। ওর তখন ওজন ৬০-৬২ কেজি; আমার মনে হয় ৪৪-৪৫। ওর সঙ্গে তাই পারি নাকি? আমি তখন এত সব বুঝতাম না। পরে খেলেছি ৪৮ কেজি ওজনশ্রেণিতে। জুডোতে আমার সব সাফল্য সেখানেই।
প্রশ্ন : জুডোতে কোচ ছিলেন কারা?
খুশী : আমাদের মূলত শেখাত ছেলে জুডোকারা। মনি ভাই আমাদের এখানে নিয়ে আসেন। পরে শিখিয়েছেন একরাম ভাই। পরে জাপান থেকে কোচ এলেন সিনেরো কিকোচি; বিয়ের পর ওনার নাম হলো ফুজিতা সিনসে। উনার কাছ থেকেই জুডোর সব কিছু শিখেছি।
প্রশ্ন : বিদেশে খেলতে যাননি কখনো?
খুশী : ষষ্ঠ এশিয়ান জুডোতে অংশ নিতে সিরিয়া যাই ১৯৮৮ সালে। তবে সেখানে তেমন সুবিধা করতে পারিনি। এমনিতেই বাংলাদেশ থেকে ওজন কমিয়ে নিয়ে যাই। ওখানে গিয়ে দেখি খাওয়া-দাওয়ার অবস্থা খুব খারাপ। কিছু মুখেই দেওয়া যায় না। ওজন বেশি কমে যায়। ফলে ভালো করতে পারিনি। এ ছাড়া উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য আমাকে একবার জাপানে পাঠানো হয় ১৯৭৫ সালে। মেয়েদের মধ্যে আমি একা; সঙ্গে তিনজন ছেলে। অচেনা দেশে কী হয়, এ নিয়ে শুরুতে একটু ভয়ে ছিলাম। কিন্তু জাপানের মতো সুন্দর দেশ হয় না। আর ওখানকার কোচ আইওয়াজাদ সিনসে, ফুজিতা সিনসেরা ভাঙা ভাঙা বাংলায় আমাকে আশ্বস্ত করেছেন, ‘খুশী আপা, ভয় করবেন না। এখানে কেউ আপনাকে কিছু বলবে না। ’
প্রশ্ন : শেষ খেলেন কবে?
খুশী : সম্ভবত ১৯৮৯ সালে। জুডো আমি চালিয়ে যেতে চেয়েছি। কিন্তু ইনজুরিতে পড়ে গেলাম যে! আনসারের একটা মেয়ের সঙ্গে খেলা ছিল; নামটা নুরী না যেন কী! ও আমাকে নিচে ফেলে আটকায়; এরপর পায়ে দেয় জাতা। ও তা ইচ্ছা করে করেছে বলে আমার মনে হয়। এভাবে মার না দিলেও পারত। এরপর দেখি ডান পায়ের ভেতরে কেমন কটকট শব্দ করে। আমাদের সঙ্গে এনায়েত বলে একটি ছেলে জুডো করত। ওর ভাই বিখ্যাত ডাক্তার হেদায়েত। মনোয়ারা হাসপাতালে ওনার কাছে যাওয়ার পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানান, ডান পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে। উনি এরপর আমার অপারেশন করেন। আমার এই ডান পায়ে কিন্তু এখনো ৭২টি সেলাই রয়েছে।
প্রশ্ন : জুডো ছাড়েন ১৯৮৯ সালে। কিন্তু এর অনেক আগেই তো জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে কোচ হিসেবে যোগ দেন, তাই না?
খুশী : হ্যাঁ। কাজী আবদুল আলিম ভাই পাতিয়ালায় জিমন্যাস্টিকসের ওপর ডিপ্লোমা করার জন্য পাঠিয়ে দেন ১৯৮০-৮১ সালের দিকে। ওখান থেকে ফিরে আসার পরই চাকরি। চাকরি করি চাকরির মতো; পাশাপাশি জুডো যাই চালিয়ে। পরে ইনজুরির কারণে খেলা ছেড়ে দিতে হয়। এমনিতে চাকরিজীবনে আমার অনেক তৃপ্তি। অনেককে আমি নিজ হাতে তৈরি করি। এই যে এখন আমি অবসরে যাওয়ার পর জিমন্যাস্টিকসের কোচ হিসেবে এসেছে নূরজাহান বেগম হীরা; ও-ও কিন্তু আমার ছাত্রী। আমার জায়গায় আমার ছাত্রী এসেছে—এটি অনেক বড় গর্বের জায়গা।
প্রশ্ন : আচ্ছা, একটা প্রসঙ্গ জিজ্ঞেস করা হয়নি। সুলতানা কামাল তো আপনাদের সমসাময়িক অ্যাথলেট। তাঁর সঙ্গে খাতির ছিল?
খুশী : খুব, খুবই আদর করতেন আমাদের। আমাকে, অনুকে, টলিকে। আমরা যখন কলেজে পড়ি, উনি তো তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেই সময় থেকে পরিচয়। ওনার ডাক নাম খুকি। আমাকে সব সময় বলতেন, ‘তোমার নাম খুশী, আমার নাম খুকি—আমরা দুজন আপন বোন। ’ দেখতে যে কী সুন্দর ছিলেন! কিন্তু তাঁর মধ্যে অহংকার বলতে কিছু নেই। আমি তো বকশীবাজারের সরকারি মহাবিদ্যালয় কলেজ থেকে ইন্টার পাস করেছি। খুকি আপার বাসা কলেজের কাছেই। ওনার বাসায় গিয়ে আমি, অনু ও টলি কত দিন খেয়েছি!
প্রশ্ন : শেখ কামালের সঙ্গেও তো তাহলে স্মৃতি রয়েছে আপনার?
খুশী : আমাদের প্র্যাকটিসের আগে-পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে আসতেন খুকি আপার সঙ্গে দেখা করতে। আমাদের সঙ্গেও গল্প করতেন কামাল ভাই। খুকি আপার মতো ওনার মধ্যেও অহংকার জিনিসটা দেখিনি। কিন্তু হাজার হলেও দেশের প্রধানমন্ত্রীর ছেলে। আমার তাই একটু ভয়-ভয়ই করত। কিন্তু অনুর ভয়ডর কিছু নেই। ও গল্প জুড়ে দিত; পাগলামি করত। কামাল ভাই ওকে দেখলেই বলতেন, ‘ওই যে, বান্দর আসছে। ’ সত্যি, অনু বাঁদরামি করত খুব। ওনার আরেকটি কথা মনে আছে। আমাদের বলতেন, ‘অ্যাই কামাল ভাই কী, আমাকে দুলাভাই বলে ডাকবি। তোরা সব আমার শালী। ’ অনু দুষ্টামি করে তাই ডাকত। আমি অবশ্য কামাল ভাইই বলতাম। আর ওনাদের মধ্যে যে প্রেম হচ্ছে, তা তেমন একটা বুঝতাম না। (পাশ থেকে যোগ করেন রবিউজ্জামান, ‘আমি একটি স্মৃতির কথা বলতে পারি। আমরা তখন তো সারা দিনই থাকি এনএসসির কোচিং সেন্টারে। পাশের এক দালানের ছাদে দেখতাম প্রায়ই খুকি আপা ও কামাল ভাই হাঁটাহাঁটি করছেন। গল্প করছেন। আমাদের সঙ্গে থাকা নাসির অনেক সময় মজা করে চিৎকার দিয়ে ডাকত, ‘কী খুকি আপা, কামাল ভাই কী বলে?’)
প্রশ্ন : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সেই ভয়াবহ ঘটনায় আপনারা তাই নিশ্চয়ই মুষড়ে পড়েন খুব?
খুশী : এমন কিছু যে হতে পারে, ভাবতেই পারিনি। আমি আর অনু তো একই বিল্ডিংয়ে থাকতাম। ও দৌড়ে এসে আমাকে বলে, ‘খুকি আপার এই অবস্থা। চল আমরা দেখে আসি। ’ শাহজাহানপুর থেকে আমরা দুটো মেয়ে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে যাই খুকি আপার টানে। ওখানে গিয়ে দেখি অনেক আর্মি। দূর থেকে অনেক রক্ত দেখেছি। কিন্তু কাছে তো আমাদের যেতে দেয়নি। খুব ভয় পেয়ে চলে আসি আবার।
প্রশ্ন : বিয়ে করেছেন খেলার ভুবনেরই একজনকে। কবে?
খুশী : ১৯৭৭ সালে। আগেই তো বলেছি, আমার স্বামী চ্যাম্পিয়ন জিমন্যাস্ট। খেলার সূত্রেই ওর সঙ্গে পরিচয়। তবে প্রেম বলতে যে ব্যাপার, তা আমাদের মধ্যে ছিল না। কিন্তু ওর সঙ্গে বোঝাপড়াটা ছিল ভালো। জিমন্যাস্টিকসে তো অন্যের কাছ থেকে কিছু সাহায্য লাগে। মেয়েরা ওই সাহায্যের জন্য ছেলেদের কাছে যেতে দ্বিধা করে। কিন্তু রবির কাছে যেতে আমার দ্বিধা ছিল না। শান্ত একটা ছেলে। এমনিতে আমার কর্তা প্রেম করার লোক না। লোকজন বলে বলে আমাদের প্রেম করিয়ে দিয়েছে। এরপর তো বিয়েই হয়ে গেল।
প্রশ্ন : আপনাদের সন্তান?
খুশী : আমাদের একটাই মেয়ে রিখি। ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে পাস করে এখন গ্রামীণফোনে চাকরি করছে। ওর স্বামী মারুফও গ্রামীণফোনে রয়েছে। লোকে ছেলে-ছেলে করে তো? কিন্তু মেয়ে আমাদের জন্য যা করেছে, তা ছেলেরাও করে না। বসুন্ধরা এলাকায় এই ফ্ল্যাটটি কিনে দিয়েছে। নয়াপল্টন থেকে এখানে এসেছি গত এপ্রিলে। ওর কাছাকাছি থাকি এখন। রিখির স্বামী মারুফও আমাদের খোঁজখবর করে সব সময়। আমাদের একটি নাতিও রয়েছে। ওর নাম রিহাম। সব মিলিয়ে ভালো আছি খুব।
প্রশ্ন : এই প্রসঙ্গে শেষ প্রশ্নটি আরেকটু বড় পরিসরে করতে চাই। সব মিলিয়ে ক্যারিয়ার নিয়ে, জীবন নিয়ে আপনার তৃপ্তি কতটা?
খুশী : খেলা-সংসার সব মিলিয়ে আমি খুব সুখী। অনেকে যা পায় না, তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু পেয়েছি আমি। খেলা দিয়েই এসেছি এত দূর। আমার জীবনের যা কিছু প্রাপ্তি, সব খেলার জন্য। খেলোয়াড় হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছি। অত অল্প বয়সে বিটিএমসিতে চাকরি করেছি। পরে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোচ তো হই সেই খেলার সূত্রে। সেখানে কাটিয়ে দিয়েছি ৩৫-৩৬ বছর। খেলার কারণেই ২০০৪ সালে পেয়েছি জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার। একটু আফসোস লাগে, জিমন্যাস্টিকসে আরো ছোটবেলায় গেলে হয়তো আরো ভালো করতে পারতাম।
আর জীবন নিয়েও আমার কোনো অভিযোগ নেই। কিছু দুর্ভাগ্য আছে। যেমন চোখটা অন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু ওই সময়ে অনেক ভালো কিছুও পেয়েছি আমি। আমার স্বামী যেমন খেলোয়াড়ি জীবন থেকে আমাকে আগলে রাখত, তখনো তাই করেছে; এখনো করছে। অফিসের কথাও বলতে পারি। ইচ্ছা করলে অন্ধ থাকার সময় ওরা আমাকে বাদ দিতে পারত। দেয়নি। চাকরি ছেড়ে দিলেও, এই এত দূরে বসুন্ধরা এলাকায় চলে এলেও এখনো প্রতি সপ্তাহে অন্তত এক দিন হলেও যাই এনএসসিতে। আজও গিয়েছিলাম। ওদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। এসব দিক দিয়ে আমি তৃপ্ত। কিন্তু অন্ধ হওয়ার আফসোস তো আছেই। এই দুর্ভাগ্য আমার কপালে লেখা ছিল, কী আর করা!
(কৃতজ্ঞতা : কালের কন্ঠ)